ইটিপি বাঁচাবে হালদা-কর্ণফুলীকে

হালদা ও কর্ণফুলী নদী রক্ষায় ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপন করবে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় নদী দুইটির দূষণরোধে নগরীর চান্দগাঁও ও মোহরা অংশে শিল্প কারখানার বর্জ্য শোধনের জন্য ইটিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ইটিপি হচ্ছে- একটি শিল্প-ভিত্তিক শোধনাগার যা কারখানা থেকে নির্গত দূষিত বর্জ্য পানিকে পরিশোধনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যাতে পরিবেশগত নিয়মকানুন মেনে পানি নিরাপদ পরিবেশে নিষ্কাশন বা পুনরায় ব্যবহার করা যায়। ইটিপি’র মাধ্যমে শিল্প কারখানার তরল বর্জ্যে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ অপসারণ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগরীর পয়োঃবর্জ্য, গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্যসহ বিভিন্ন কারণে প্রায় তিন দশক ধরে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা ও কর্ণফুলী নদী। মূলত ওয়াসার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় নগরীর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের পয়োঃবর্জ্য, গৃহস্থালি ও শিল্প কারখানার বর্জ্য নালা ও খাল হয়ে সরাসরি এ দুইটি নদীতে পড়ছে। এ অবস্থায় হুমকিতে পড়েছে হালদার রুই জাতীয় ও অন্যান্য প্রজাতির মাছ, ডলফিনসহ জীববৈচিত্র্য এবং কর্ণফুলী নদীর মাছ।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজের ওপর প্রণীত মাস্টার প্ল্যাণের তথ্য অনুযায়ী- নগরীতে বর্তমানে দৈনিক ৪০ কোটি লিটার তরলবর্জ্য নিঃসৃত হয়। ২০৩০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ কোটি লিটার। ওয়াসার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে নগরীর নিঃসৃত তরল বর্জ্য সরাসরি বিভিন্ন নালা ও খাল হয়ে হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। তাতে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। অথচ এ দুটি নদী ওয়াসার সুপেয় পানির প্রধান উৎস। এছাড়া নগরীতে দৈনিক আরো প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এসব বর্জ্যরে একটি অংশও হালদা নদীতে গিয়ে পড়ে। নগরীর তরল ও কঠিন বর্জ্য ছাড়াও নদীর দুই ধারের শিল্পকারখানার দূষিত কেমিক্যালও হালদা ও কর্ণফুলী গিয়ে পড়ে। এ কারণে ক্রমাগত দূষণের শিকার হচ্ছে এ দুইটি নদী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পকারখানায় ইটিপি’র ব্যবস্থা না থাকায় চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত বেশিভাগ শিল্প কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ে। বিশেষ করে নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চল, অক্সিজেন, কূলগাঁও, চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার শিল্পকারখানা ও আবাসিকের তরল বর্জ্য সরাসরি হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। দূষণের কারণে একদিকে নদীর সুপেয় পানি দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে মৎস্য সম্পদের ওপর পড়েছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কোঅর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া পূর্বকোণকে বলেন, ‘এক সময় মাছে ভরপুর ছিল হালদা সংশ্লিষ্ট চারটি গুরুত্বপূর্ণ খাল। কিন্তু তিন দশকের ব্যবধানে এ চিত্র পাল্টে গেছে। এখন এসব খালের মাধ্যমে হালদায় দূষণ ছড়াচ্ছে বেশি। নদীর শাখা খাল খন্দকিয়া, কৃষ্ণখালী, বামনশাহী ও কাটাখালী খালের মাধ্যমে প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরের বিষাক্ত তরল বর্জ্য মিশ্রিত পানি পড়ছে হালদায়। এ অবস্থায় দূষণ রোধে সরকার ইটিপি স্থাপনের উদ্যোগের বিষয়টি খুবই স্বস্তিদায়ক। আশা করি অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে সরকার খুব দ্রæত ইটিপি স্থাপন করবে।’

দূষণ সম্পর্কে মোহরা এলাকার বাসিন্দা খোরশেদ আলমদার পূর্বকোণকে বলেন, কৃষ্ণখালী খালটি অনন্যা আবাসিক সংলগ্ন পশ্চিম কুয়াইশ এলাকা থেকে সৃষ্টি হয়ে নগরীর মোহরা ওয়ার্ডের মধ্য দিয়ে হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়ন এলাকায় সরাসরি হালদার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এ খালের মাধ্যমে প্রতিদিন নগরীর নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চল, অক্সিজেন, কূলগাঁও এলাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের চান্দগাঁও ও মোহরা ওয়ার্ডের শিল্প বর্জ্য সরাসরি হালদায় পড়ে। এক সময় খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন দূষণের কারণে মাছ দূরে থাক উৎকট দুর্গন্ধে খালের পাড়ে হাঁটাও যায় না।’

ইটিপি স্থাপনের উদ্যোগ সম্পর্কে হালদা প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে রাষ্টীয় অতিথি ভবন যমুনার সভাকক্ষে গত ৩০ জুলাই এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে ওই সভায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত হয় যে, হালদার দূষণরোধে ইটিপি স্থাপনের। স্থানীয় সরকার বিভাগকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইটিপি স্থাপন হলে শুধু হালদা নয়, কর্ণফুলী নদীরও দূষণ অনেকখানি কমে আসবে।’