উন্নয়ন হচ্ছে মানবিক মুক্তি প্রসারিত করার প্রক্রিয়া

১৯৪৪ সালের এক বিকেলে অমর্ত্য সেন স্কুল ছুটিতে শান্তিনিকেতন থেকে ঢাকায় ফিরে এলেন। এসে তাদের ওয়ারীর ‘জগৎ কুটির’ বাড়ির বাগানে একাই খেলছিলেন। এমন সময় হঠাৎ বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে পড়ল একজন লোক; তার বুকে ও পিঠে মারাত্মক ছুরিকাঘাত, শরীর থেকে বিপুলভাবে রক্ত ঝরছে এবং সে তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করছে। লোকটির নাম কাদের মিয়া, পেশায় দিনমজুর।

অমর্ত্য সেনের বাড়ির অনতি দূরে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার কোনো এক বাড়িতে অতি ক্ষুদ্র পারিশ্রমিকে কিছু কাজ সেরে যখন বাড়ি ফিরছিলেন, রাস্তায় সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আহত এবং তীব্র বেদনায় কাতরানো কাদের মিয়া বাগানে উপস্থিত বালকের কাছে একটু পানি ও সাহায্য চাইলে সেই মুহূর্তে হতভম্ব অমর্ত্য সেন দৌড়ে পানি আনতে গেলেন এবং চিৎকার করে মা-বাবাকে ডাকলেন। তার বাবা আশুতোষ সেন তাড়াহুড়া করে কাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু হায়, ছুরিকাঘাত থেকে বেঁচে থাকতে পারলেন না কাদের মিয়া। অমর্ত্য সেনের বয়স তখন ১১ ছুঁই ছুঁই। কাদের মিয়ার এভাবে মৃত্যু তিনি কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নোংরা দিক সম্পর্কে আগে থেকেই তার কিঞ্চিৎ ধারণা ছিল, কিন্তু সেই বিকেলে যখন কাদেরের রক্তাক্ত শরীর আলম্বিত করে পানি পানে সাহায্য করছিলেন, এমনকি কাদেরের যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন তার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে পশুবৎ বিভীষিকা 

এবং পরিকল্পিত বিভাজন ও রোপিত বিদ্বেষের ভয়াবহ পরিণাম। ওই ঘটনার নৃশংসতার দিক বাদ দিলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন না কেন ঘাতকরা কাদেরকে হত্যা করতে চাইল, যারা এমনকি তাকে চিনতই না।

আসলে এই নিবেদিত খুনিদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো এই খবর যে কাদের মিয়া একজন মুসলমান ছিলেন। 

এর পর থেকে অমর্ত্য সেন যখনই গোষ্ঠীভিত্তিক পরিচয়ের আড়ালে প্রায়ই লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতার কথা চিন্তা করতেন, তার কাছে সেই বিকেলের স্মৃতি বারবার ফিরে আসত। তিনি ভাবলেন, সাম্প্রদায়িক বিবাদের সময় মানুষকে একমাত্রিকতায় নামিয়ে আনা সহিংসতা উসকানোর উৎ হিসেবে কাজ করতে পারে। গোষ্ঠীভিত্তিক কর্মকাণ্ড একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যকার বন্ধন ও সংবেদনশীলতা তৈরি করতে পারে, তা সত্ত্বেও জীবনব্যাপী যদি গোষ্ঠীগত দর্শন নিয়ে সংশয়বাদী হয়ে থাকেন, তার পেছনে কাজ করেছে প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত গোষ্ঠীভিত্তিক শ্রেণীকরণের অমানবিক দিকটি—যেমন ঘটল ঢাকায় কাদের মিয়ার সঙ্গে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এই বিখ্যাত বইয়ের শিরোনাম—স্বরূপতা এবং সহিংসতা : নিয়তির মোহ (Identity and Violence : The Illusion of Destiny)। বলা বাহুল্য নয় যে বইটি লেখার পেছনে জ্বালানি জুগিয়েছিল সেদিনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-উৎসারিত তার অন্তরের তীব্র জ্বালা—‘আমি অনুভব না করে পারছিলাম না যে আমি একটা ভ্রমণ শেষ করতে যাচ্ছি মাত্র, যেটা শুরু হয়েছিল অনেক দশক আগে কাদের মিয়ার খুনের সেই রক্তভেজা বিকালে।’

 

দুই.

হাসপাতালে নেওয়ার সময় কাদের মিয়া কাতরাতে কাতরাতে অমর্ত্য সেনের বাবাকে বলেছিলেন, তার স্ত্রী অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি যেন শত্রুপক্ষীয় জায়গায় না যান। কিন্তু পরিবারের খাবার নেই বলে বাধ্য হয়ে সামান্য মজুরিতে কাজের সন্ধানে তাকে বের হতে হয়। পরিতাপের বিষয়, সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবের (Economic unfreedom) শাস্তি হয়ে দাঁড়াল মৃত্যু। যদি পরিবারটি ক্ষুদ্র উপার্জন ছাড়াই চলতে পারত, তাহলে গোলযোগের সময় সামান্য মজুরির জন্য কাদের

অন্যদের এবং নিজেদের একটি একক পরিচয়ে দেখার বিপদ নিয়ে অনেক দশক পর তিনি একটি বই লিখলেন। মিয়ার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। কাদের অমর্ত্য সেনের মাকেও বলেছিলেন, ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতে পারেননি বিধায় তাদের জন্য খাবার কিনতে কাজে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তথ্যসূত্রের কালের কন্ঠ