দুই বছর আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ ছিল না জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের। গত এক বছরে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এই পুরো বছর কাজে লাগিয়েছে ছাত্রশিবির। অন্যদিকে সংগঠন গোছাতে পারেনি ছাত্রদল। আর সেই অগোছালো অবস্থার খেসারত দিতে হলো এবারের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে।
ছাত্রশিবির গত এক বছরে ক্যাম্পাসে নিজস্ব শৃঙ্খলা ও সুসংগঠিত কাঠামো গড়ে তোলে। নিয়মিত সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক আয়োজন, অনলাইন ক্যাম্পেইন—সবকিছুতেই তারা দেখিয়েছে সংগঠিত উপস্থিতি। ফলে নির্বাচনের ময়দানে তারা ছিল প্রস্তুত, ছাত্রদল ছিল এলোমেলো।
গত বুধবার অনুষ্ঠিত সপ্তম চাকসু নির্বাচনে ২৬টির মধ্যে ২৪টি পদে জয়ী হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’। শীর্ষ দুই পদ—সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস)—উভয়েই পেয়েছেন শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা। তবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে জয় পান ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান।
নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ। সে হিসাবে ভোট দিয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার ৮৮৫ জন। এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির পেয়েছিল প্রথম জয়। এরপর ১৯৯০ সালে হেরে যায় তারা। ফলে ৪৪ বছর পর আবার চাকসুর নেতৃত্বে ফিরল ছাত্রশিবির।
ছাত্রদল যেখানে পিছিয়ে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি ৫ সদস্যের, তাও দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ১১ আগস্টে ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এই কমিটির মেয়াদ শেষ। কমিটির নেতারা হলেন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মহসিন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি (বর্তমানে বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন। এ পাঁচজনের কারও নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই।
নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ। সে হিসাবে ভোট দিয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার ৮৮৫ জন। এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির পেয়েছিল প্রথম জয়। এরপর ১৯৯০ সালে হেরে যায় তারা। ফলে ৪৪ বছর পর আবার চাকসুর নেতৃত্বে ফিরল ছাত্রশিবির।
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। এমনকি বিএনপি সরকারে থাকাকালেও (২০০১-০৬) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ছাত্রদল। তখন শিবিরের প্রভাব ছিল প্রবল, পরে আসে ছাত্রলীগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর উন্মুক্ত পরিবেশ ফিরে এলেও ছাত্রদল সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। হলে কোনো শক্ত অবস্থান তৈরি হয়নি। এমনকি প্রার্থী বাছাইয়েও দেখা গেছে মতবিরোধ ও অনৈক্য।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অন্তত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো প্রস্তুতির অভাব, সংগঠনের বিভাজন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং যোগাযোগহীনতা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কার্যত বিভক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অন্তত তিন ভাগে বিভক্ত। চাকসু নির্বাচনেও এক হতে পারেননি। যেমন ছাত্রদলের ৫ সদস্যের কমিটিতে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ। তিনি ছাত্রদল-মনোনীত প্যানেলের বাইরের এক প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এ ঘটনার পর তাঁকে আজীবনের জন্য সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এই নির্বাচনের জন্য আমাদের এক বছরের পরিকল্পনা ছিল। গত এক বছরে ৮ শতাধিক কর্মসূচি পালন করেছি। এর মধ্যে নবীনবরণ, বিতর্ক, আন্তর্জাতিক সেমিনার, গণ-ইফতার, কৃতী সংবর্ধনাসহ নানা কর্মসূচি ছিল। সবকিছুই ছিল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অংশ।
সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে নাছির উদ্দীন বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কাঠামো গঠন করতে পারিনি। এখন আমাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই কমিটি ঘোষণা করা হবে।’

ছাত্রশিবিরের দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রভাব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয়। আশির দশক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর প্রায় এক দশক আত্মগোপনে থাকে সংগঠনটি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ হারায় ছাত্রলীগ। সেই শূন্যস্থানে আবার সংগঠিত হয় ছাত্রশিবির। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্যে আসেন তাদের সভাপতি ও সেক্রেটারি। পরে অক্টোবর মাসে প্রকাশ্যে আসেন সাহিত্য সম্পাদক সাঈদ বিন হাবিব, যিনি এবার নির্বাচনে জিএস পদে জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে একচেটিয়া জয়ের বিষয়ে সাঈদ বিন হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নির্বাচনের জন্য আমাদের এক বছরের পরিকল্পনা ছিল। গত এক বছরে ৮ শতাধিক কর্মসূচি পালন করেছি। এর মধ্যে নবীনবরণ, বিতর্ক, আন্তর্জাতিক সেমিনার, গণ-ইফতার, কৃতী সংবর্ধনাসহ নানা কর্মসূচি ছিল। সবকিছুই ছিল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অংশ।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিবিরের ৪৪ বছর পর পাওয়া এ জয় শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশকও। অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তফা গালিব প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদল প্রচারণার শুরু থেকেই পিছিয়ে ছিল। অনলাইনে তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। ভিপি-জিএস ও এজিএস প্রার্থী ছাড়া বাকিরা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারেননি। ছাত্রশিবিরের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনি।