সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মফিজুর রহমানের একটি ব্যাংক হিসাব ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। হিসাবটি তিনি গোপনে পরিচালনা করেন। উত্তাল আগস্টের ৮ তারিখ একদিনেই এই হিসাবে ২০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। ছয় বছরে এই অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৬৯ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, টিআর-কাবিখার অর্থ আত্মসাৎ এবং অবৈধ বালু ব্যবসা ও চোরাচালানে যোগসাজশসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মফিজুর। ওই ব্যাংক হিসাবই তার অবৈধ আয়ের সাক্ষী।
জেলায় তিনিই একমাত্র কর্মকর্তা যিনি ২০২৩ সাল থেকে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তাকে সরাতে স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে আন্দোলনও চলছে। এই আন্দোলন প্রতিহত করতে ইউএনও ভাড়া করেছেন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের। তারা যুবদল, সমন্বয়ক ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী পরিচয়ে সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেছে।
এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বহুল আলোচিত ধোপাজান ও জাদুকাটা নদীতে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশকে অবৈধ বালু ব্যবসার সুযোগ দিয়েছেন ইউএনও। তারা ইউএনওকে লাখ-লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি করছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বম্বরপুর উপজেলায় যোগদান করেন মফিজুর। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সাদিরচরে। সরকার পরিবর্তনের পর খোলস পালটে বিএনপি বলয়ের সঙ্গে মিশে গেছেন তিনি। এমনকি স্থানীয় কালোবাজারি ও বালুখেকোদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ডাচবাংলা ব্যাংকে তার একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকার বিবরণী যুগান্তরের কাছে এসেছে। এতে দেখা গেছে, প্রায় ৬৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে এই কর্মকর্তার হিসাবে। যা তার আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইউএনও মফিজুরের অবৈধ আয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মফিজুরের ব্যাংক হিসাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাবস্থায় বেসরকারি ওই ব্যাংকে হিসাবটি (নং ২৬৪১৫১০০১৫৬৩৭) খোলেন তিনি। খোলার সময়ই সেখানে জমা করেন প্রায় ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এরপর গত ৮ আগস্ট জমা করেন ২০ লাখ টাকা। ৫ আগস্টের পর ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করায় একসঙ্গে ২০ লাখ টাকা জমা দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা। এ কারণে মোট ১১ বারে এই টাকা জমা দেওয়া হয়। সেখানে জমাকারী হিসাবে একটি মোবাইল নাম্বার উল্লেখ রয়েছে।
জানা যায়, মোবাইল নম্বরটি বিশ্বম্বরপুরের মো. আলাল উদ্দিন নামে একজনের। জানতে চাইলে আলাল উদ্দিন বলেন, আমি ওই সময় বিশ্বম্ভরপুর ইউএনও অফিসে মাস্টাররোলে কাজ করছিলাম। ইউএনও স্যার ৮ আগস্ট আমাকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপকের কাছে দিয়ে আসতে। আমি ওইদিন সকালে টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার আমার মোবাইল নাম্বারসহ নাম লিখে রাখেন। এরপর সম্ভবত ওই টাকা জমাকারী হিসাবে অনলাইনে আমার মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করেন। আসলে আমি শুধু ইউএনও স্যারের নির্দেশ পালন করেছি, আর কিছু জানি না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিগত সরকারের দোসর হিসাবে পরিচিত কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান অবৈধ চিনি চোরাকারবারি ও বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা ইউএনওকে মোটা অঙ্কের টাকা ভাগ দিতেন। সরকার পরিবর্তনের পর অবৈধ বালু ব্যবসায় নিয়োজিত হয় বিএনপি পরিচয়ে কিছু লোক। তাদেরকে বগলদাবা করেছেন মফিজুর। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে উপজেলায় বরাদ্দ আসা টিআর-কাবিখাসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন।
ইউএনওর ঘুস কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মফিজুর তার বাসভবনের সামনে ৩০ লাখ টাকা খরচ করে অপ্রয়োজনীয় ডাইনিং রুম বানিয়েছেন। ৭ লাখ টাকায় পুকুর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নির্মাণ করেছেন ঘাটলা। লাখ লাখ টাকায় ছোট ছোট কায়েকটি নৌকা কিনে পুকুরে ভাসিয়েছেন। এ ছাড়া কাগজেকলমে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে দুটি কক্ষ বানিয়ে সরকারি তহবিলের অপচয় করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের অভ্যন্তরে মাল্টিপারপাস সেন্টারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার থাকার পরও উপজেলা নির্বাচন অফিসের পাশে আরেকটি পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করে টাকা আত্মসাতের ক্ষেত্র তৈরি করেন। এসব প্রকল্পে দরপত্র প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে। অথচ পর্যটকদের আকর্ষণীয় করে তুলতে এর আগে যেসব স্থাপনা, যেমন-পাহাড় বিলাস পর্যটন কেন্দ্র, হাওড় বিলাস, হাওড় ভিউ ক্যাফে, মুক্তিযোদ্ধা উদ্যান এবং বিভিন্ন বাজারের ওয়াকওয়েসহ অন্যান্য কাঠামো অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বম্বরপুরের ইউএনও মফিজুর রহমান মঙ্গলবার বলেন, আমি এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাবস্থায় এই হিসাব খুলেছি কিনা এখন বলতে পারছি না। সন্ত্রাসীদের দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, আসলে সুবিধাভোগী কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।