চাকসুতে শীর্ষ তিন পদে মাত্র তিন নারী

আসন্ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদ সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদকে (এজিএস) লড়তে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৬৭ জন। এতো এতো প্রার্থীর ভিড়ে কিনা নারী প্রার্থী শুধুই তিনজন। যা মোট প্রার্থীর সাড়ে চার শতাংশেরও কম। অথচ মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।

নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত ১২টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। সেসব প্যানেলের দশটিতেই শীর্ষ পদগুলোতে কোনো নারীকে রাখা হয়নি। একটি প্যানেলে এক নারী জিএস পদে স্থান পেয়েছেন। অন্য প্যানেলের হয়ে আরেকজন নারী এজিএস পদে নির্বাচন করছেন। অন্যজন স্বতন্ত্র হিসেবে এজিএস পদে নির্বাচনে লড়ছেন।

প্রার্থী ও বিশিষ্টজনেরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের প্রতি ব্যাপক হারে অনলাইন-অফলাইনে স্লাট শেমিংয়ের (যৌন আচরণ বা পোশাকের কারণে নারীদের জনসমক্ষে অপমান করা, সমালোচনা করা বা লজ্জিত করা) শিকার হতে দেখা গেছে। সেই দৃশ্য দেখার পর হয়তো চাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে অনেক নারীই আগ্রহ হারিয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে না ওঠা, রাজনীতিবিমুখতাও বড় কারণ মনে করছেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন নারীদের নির্বাচনবিমুখতার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘শহর থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব সবচেয়ে বড় কারণ। প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে গিয়ে ক্যাম্পেইন করে নির্বাচন করা অনেক নারীর পক্ষে কষ্টসাধ্য। এছাড়া অনলাইন-অফলাইনে বুলিংয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কা, প্রচারণার ঝামেলা নিতে না চাওয়া, বাড়ি থেকে অনুমতি না পাওয়া, একাডেমিক পড়াশোনার চাপ-এসব কারণ তো আছেই।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগের সভাপতি দিলরুবা আক্তার মনে করেন ডাকসুর অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়েছেন চবির নারী শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, ‘ডাকসুর নির্বাচনে অনেক নারী প্রার্থীকে ব্যাপক ¯øাট শেমিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। সেটি দেখে হয়তো চবির নারী শিক্ষার্থীরা মনে করেছেন-নির্বাচনে আসলে তাদেরও একই সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে চাকসুর শীর্ষপদগুলোতে নারী প্রার্থী কম হতে পারে।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন একত্র হয়ে দেওয়া ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করছেন চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের এই শিক্ষার্থী মনে করেন দুই কারণে নারী প্রার্থী আশঙ্কাজনক হারে কম।

চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। নারীরা আশঙ্কা করছেন-নির্বাচনে এলে স্লাট শেমিংয়ের শিকার হলে বিচার পাবেন না। আরেকটি বিষয় হলো-আমাদের পুরো প্রজন্মটাই বড় হয়েছে অপরাজনীতি দেখে। তারা কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেনি। সেজন্য রাজনীতি-নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে একটা অনীহা তৈরি হয়েছে। এটাও নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার বড় কারণ হতে পারে।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এজিএস পদে লড়ছেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছাবেকুর নাহার জিসান। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে মেয়েরা এখনো নিজেদের নিরাপদ অনুভব করছেন না। আরেকটি বিষয়Ñরাজনীতিতে শীর্ষ পদগুলোতে নারীরা বসবেন, এটা এখনো এই দেশে অস্বাভাবিক। আর বসলেও কতটা সম্মানজনকভাবে কাজ করতে পারবেন, সেই আশঙ্কাও রয়ে যায়। এসব কারণে নারীরা কম আগ্রহ দেখান। আমি নারীদের সেই ‘ভয়’ ভেঙে দিতে সবার হয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি।’

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন-প্যানেলের হয়ে এজিএস পদে লড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘অনেক বছর পর চাকসু নির্বাচন হচ্ছে সেটিও নারী প্রার্থী কম হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হতে পারে। আরেকটি বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ বহু বছর থেকেই নেই। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে অনেকে নারীদের সেভাবে শীর্ষ পর্যায়ে দেখতে চান না, আর নারীরাও ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। অবশ্য এখন একটু করে হলেও নারীরা এগিয়ে আসছে। হয়তো পরের বার নির্বাচন হলে অনেক নারীই আগ্রহী হয়ে নির্বাচনে আসবেন।’

শুধু শীর্ষ তিন পদে নয়, অন্যান্য পদগুলোতেও নারী প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। চাকসুর মোট ২৮ পদের মধ্যে নির্বাচিত হবেন ২৬ জন। পদাধিকারবলে সভাপতি থাকবেন উপাচার্য আর কোষাধ্যক্ষ পদে সভাপতিই একজন শিক্ষককে মনোনীত করবেন। বাছাই শেষে ৪১৫ জনের প্রার্থীতা বৈধ ঘোষণা করেছিল। তাদের মাত্র ৪৭ জন নারী। আগামী ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য চাকসু নির্বাচনে পুরুষ প্রার্থীদের ভিড়ে-কতজন নারী জয়ী হয়ে আসতে পারেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।