Search
Close this search box.

পুলিশের হাতে ‘মারণাস্ত্র’ না রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের, বিশেষজ্ঞ ও বাহিনীর সদস্যরা যা বলছেন

ছাত্র–জনতার অভুত্থ্যানে পুলিশের বিতর্কিত ও প্রাণঘাতী ভূমিকার কারণে তাদের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এমন কী গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনেও পুলিশের হাতে এ ধরনের অস্ত্র না রাখার সুপারিশ করেছিলেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের হাতে চায়নিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান, ৯ এমএম পিস্তলের মতো ‘মারণাস্ত্র’ না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সোমবার (১২ মে) আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

এই সিদ্ধান্তের কথা জানার পরই পুলিশ বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মধ্যে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। তাদের দাবি, অস্ত্র ছাড়া কাজ করতে গেলে পুলিশের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক হচ্ছে না। আত্মরক্ষা ও অপরাধ দমনে ব্যবহৃত অস্ত্র কেড়ে নিলে পুলিশের মনোবল আরও দুর্বল হয়ে যাবে।

যা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা:
পুলিশের হাতে ‘মারণাস্ত্র’ না রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মারণাস্ত্র থাকবে শুধু এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) কাছে। পুলিশের অভিযানে যেতে মারণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। পুলিশের কাছে থাকা মারণাস্ত্র জমা দেবে।
পুলিশের হাতে কোন কোন ধরনের অস্ত্র রাখা যাবে, কীভাবে কাজ করবে, সেসব বিষয় ঠিক করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

কী বলছেন সাধারণ পুলিশ সদস্যরা:
পুলিশের কাছে প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কথা হয় উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে যাওয়ার ৯ এমএম পিস্তল ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এখনও হামলার শিকার হচ্ছে। এছাড়াও পুলিশেরও আত্মরক্ষার ব্যপার আছে। ভয়ঙ্কর আসামি ধরতে গিয়ে তাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এমন সময় এই সিন্ধান্ত খুবই উদ্বেগজনক। অবশ্যই পুলিশের কাছে অস্ত্র রাখার প্রয়োজন আছে। পুলিশের নিজের কাছেই যদি অস্ত্র না থাকে তাহলে তারা অস্ত্রধারী আসামিদের গ্রেপ্তার করবে কীভাবে? আর কোনো অভিযানে গিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়লে কী করবে?

সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা জানান, গতকাল (সোমবার) থেকেই বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ব্যপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। পুলিশের কাছে যদি অস্ত্র না থাকে তাহলে কী তারা লাঠি হাতে নিয়ে ডিউটি করবে? এখন অস্ত্র থাকার পরও মানুষ পুলিশকে মানতে চাচ্ছে না, তাহলে অস্ত্র কেড়ে নিলে কী অবস্থা হবে?

কনস্টেবল পদমর্যাদার এক পুলিশ সদস্য বলেন, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে বলে আমি মনে করি। তখন বিপজ্জনক কোনো অভিযানে যেতে চাইবে না পুলিশ সদস্যরা। বিপজ্জনক আসামিও গ্রেপ্তার করতে যেতে চাইবে না কেউ। কারণ কেউ-ই চাইবে না আসামি ধরতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করতে। এতে অপরাধ আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞের মতামত:
পুলিশের কাছে অস্ত্র না রাখার বিষয়ে কথা হয় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুকের সঙ্গে। ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিষয়ে দেশের প্রথম এই অধ্যাপকের মতে, বর্তমান পরিস্থিতে এটা কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই অপরাধ বিজ্ঞানী এবং ভিক্টিমোলজিস্ট বলেন, পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলে তাদের মনোবল আরও দুর্বল যাবে। অস্ত্র থাকা না থাকা বড় ব্যপার না। বড় বিষয় হচ্ছে অস্ত্র ব্যবহার সঠিকভাবে হচ্ছে সেটা নিশ্চিত করা।

এশিয়ান সোসাইটি অব ভিক্টিমোলজির সভাপতি ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক আরও বলেন, পুলিশের কাছে অস্ত্র নেই জানলে জনগণ পুলিশকে সেভাবে আর পরোয়া করবে না। বিশেষ করে সন্ত্রাসীরা যখন জানবে পুলিশের কাছে তাদের মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র নেই, পুলিশ তাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না তাহলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে। সহিংস অপরাধের জন্য তারা উৎসাহী আরও বেশি উৎসাহী হবে। কারণ সন্ত্রাসীদের কাছে তো ভারী অস্ত্র থাকে। সন্ত্রাসীরা যখন জানবে পুলিশের কাছে তাদের মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র নেই তখন তারা পুলিশকে আর ভয়ের কিছু মনে করবে না।

তিনি বলেন, ভারী অস্ত্র থাকলেই ভালো হতো। বরং অস্ত্রটা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সঠিক স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সেগুলো মনিটরিং করা উচিত ছিল। মাথা ব্যাথা হয়েছে বলে তো আমরা মাথা কেটে ফেলতে পারি না। কিন্তু এই সিন্ধান্ত মাথা কেটে ফেলার মতোই হয়ে যাচ্ছে। আমার মতে এই মুহূর্তের জন্য এটা কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আপাতত এটা ঠিক হবে না। পরবর্তীতে এটা দেখা যেতে পারে।