বাংলাদেশকে নিয়ে কেন ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া?

সম্প্রতি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর থেকে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবেদনে আপত্তিকর ভাষা ও উপস্থাপনা এবং তথ্য যাচাই না করেই তা প্রকাশ করা হচ্ছে ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যমে। সেগুলো আবার ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজবের সূত্র ধরে সংবাদ পরিবেশন করছে ভারতের নানা খবরের কাগজ-টিভিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে একটা বিরোধিতার সুর দেখা যাচ্ছিল। তবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারির পরে তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। ‘হাজার হাজার হিন্দুকে বাংলাদেশে হত্যা করা হচ্ছে, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে’- এ ধরনের বাক্য প্রায়শই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে ভারতে সংঘটিত বিক্ষোভগুলো থেকে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ভাষণ, কাগজ-টিভির প্রতিবেদন এবং সামাজিক মাধ্যম – সব মিলিয়ে যে আখ্যান তৈরি করা হচ্ছে ভারতে, তা দেশটির হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে অনেক সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে ফেলছেন।

সম্প্রতি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক ভিডিও মিথা, তবে শনাক্ত করেছে। ভারতের তথ্য যাচাই ও ভুয়া খবরের খোঁজ দেয় এ রকম একটি ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর খুঁজে পেয়েছে, যেগুলোতে ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ’ হচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে।

এইসব ভুয়া টুইট বা ফেসবুক পোস্টগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সেভ বাংলাদেশি হিন্দুজ’ বা ‘অল আইজ অন বাংলাদেশি হিন্দুজ’ অথবা ‘প্রে ফর বাংলাদেশি হিন্দুজ’। আরো একটি বাক্য এ ধরনের ভুয়া পোস্টগুলোতে দেখা গেছে, যার মোটামুটি বাংলা অনুবাদ হলো- ‘জিহাদিরা বাংলাদেশের হিন্দুদের কেটে ফেলছে অথচ বিশ্ব একেবারে চুপ করে আছে।

অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে এটাও যেমন ঘটনা, তেমনই এটাও সত্য যে বহু ভুয়া খবর, অসত্য তথ্য সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে মূলত দক্ষিণপন্থী সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এর মধ্যে অনেক ভুয়া তথ্যই আবার মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে – এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’

দেখা গেছে, মাজার ভাঙচুরের ভিডিওকে হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভারতের বর্ধমানে প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিওকে বাংলাদেশে মন্দিরে হামলার ভিডিও বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ওই ওয়েবসাইটটি ২৯ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একটি ভিডিও কিভাবে হিন্দুত্ববাদী সামাজিক মাধ্যমগুলো ‘হিন্দুদের গণহত্যা’ বলে ছড়িয়ে দিয়েছে। ওই ভিডিওর ডেস্ক্রিপশনে লেখা হয়েছে ‘বাংলাদেশি হিন্দুদের গণহত্যা ভারত এবং সারা বিশ্বের হিন্দুদের চোখ খুলে দিয়েছে। আপনার বাংলাদেশের ভাই-বোনেদের পরিত্যাগ করবেন না–তারা হাসিনার পতনের পর থেকেই ইসলামীদের রাগের শিকার হচ্ছেন।’

 

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কয়েকটি ভিডিও একসঙ্গে জুড়ে একটি পোস্ট করেছিলেন, যার মধ্যে অল্ট নিউজ দেখতে পেয়েছে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ওই প্রথম ভিডিওটিও। এই টুইটের ডেসক্রিপশনে তিনি লিখেছিলেন যে কিভাবে সনাতনি হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হচ্ছে। তিনি অবশ্য ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা যে এই ঘটনাগুলোকে এখনো বলা যায় না, সেটাও লিখেছিলেন।

অল্ট নিউজ খুঁজে পেয়েছে যে আসলে ভিডিওটি বাংলাদেশের বিডিনিউজ২৪.কম-এর এবং ঘটনাটি ছিল ২৫ নভেম্বরের, যেদিন ঢাকার মাতুয়াইলের মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ আর কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্ররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মোল্লা কলেজের ছাত্র অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এর সঙ্গে কোনো ‘হিন্দুদের গণহত্যার’ যোগই নেই। তবুও লাখ লাখ মানুষ ওইসব ভিডিও দেখেছেন, রিটুইট করেছেন–যার ফলে একটা জনমত তৈরি হতে শুরু করে দেয়।

তথ্য যাচাই না করেই প্রকাশ?

একটি সর্বভারতীয় টিভি নিউজ নেটওয়ার্কের পূর্বাঞ্চলীয় সম্পাদক বিশ্ব মজুমদার তথ্য যাচাই না করে প্রকাশের বিষয়টি স্বীকার করলেন। যদিও তার অধীনস্থ কোনো চ্যানেল ওপরে উল্লিখিত ‘হিন্দু বসতিতে আগুন’এর ভিডিওটি দেখায়নি।

‘নেটওয়ার্ক ১৮’-এর পূর্বাঞ্চলীয় সম্পাদক বিশ্ব মজুমদার বলেন, ‘কোনো তথ্য বা ভিডিও পেলে সেটা যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপারটাই এখন উঠে গেছে। আমরা যে সাংবাদিকতার শিক্ষা পেয়েছি, ২৫-৩০ বছর ধরে কাজ করছি, তাদের সঙ্গে এখনকার সাংবাদিকদের কাজের ধরণটাই বদলে গেছে। এরা যেকোনো ঘটনা ঘটলে সেটা যাচাই না করেই অন্য চ্যানেলে দেখতে পেলেই তা চালিয়ে দেয়। ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতা চলছে এটা! কে কত আগে সেনসেশন তৈরি করতে পারবে, সেই লড়াই চলছে চ্যানেলগুলোর মধ্যে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে যা সংবাদমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, তা সত্যিই সাংবাদিকতা নয়।

বাংলাদেশ নিয়ে আখ্যান বদল কেন?

একটা সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ আর ভারতে ‘সুসম্পর্ক’ নিয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হত। কিন্তু পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে মূল ধারার গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করেছে। তারা বারবার প্রশ্ন তুলছে বাংলাদেশের সরকারের পরিচালনা নিয়ে, কারা এই সরকার ‘আসলে’ পরিচালনা করছে, তা নিয়ে।

পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পাল বলছিলেন, ‘ভারতের মিডিয়ায় এর আগে যেভাবে ভারত-বন্ধু শেখ হাসিনার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখিয়েছে, ঠিক সেই পথেই অধিকাংশ মিডিয়া হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূস পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কারণ, তারা মনে করছে, বাংলাদেশের এই সরকার ভারতের বর্তমান শাসকদলের বিরোধী।’

তার কথায়, ‘২০২১ সালে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে ভারতের মিডিয়া এতটা উচ্চগ্রামে খবর করেনি। কারণ তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি মোদিঘনিষ্ঠ ছিলেন। ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তারা ওই অবস্থান নিয়েছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা বদলিয়েছে।’

ভারতের হিন্দু ভোট আসল লক্ষ্য?

বাংলাদেশের হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পরে গত দেড় সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় যত বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে, সেখানে হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীদের মুখে একটা কথা বারে বারে শোনা গেছে যে হিন্দুরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হন তাহলে ভারতেও একই পরিস্থিতি হবে।

 

সূত্রের কালের কন্ঠ