পৃথিবীর যে সব দেশসমূহে স্বাভাবিক রাত-দিন রয়েছে, সে সব দেশেসমূহে তো নামাজ-রোজার সময় নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। তবে মেরু অঞ্চলের ওই সব দেশসমূহে যাতে বছরের বিভিন্ন সময়ে দিবারাত্রি অস্বাভাবিক বড়-ছোট হয়ে যায়, সেখানে নামাজ-রোজা আদায়ে সমস্যা হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের বেশ কিছু এলাকায় বছরের কোনো কোনো সময়ে ইফতারের সময় হওয়ার কিছুক্ষণ পরে এশার সময় আসার পূর্বেই পুনরায় ফজরের সময় হয়ে যায়। এ জন্য সে সব দেশসমূহের নামাজ-রোজার বিধান আলেমরা কোরআন-সুন্নাহ গবেষণা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
অধিকাংশ আলেম এসব এলাকার মুসলমানদের নামাজ রোজার সকল বিধান বলবত্ থাকারই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তবে তা আদায়ের নিয়মের মধ্যে কিছু ব্যাখ্যা আছে। (হাশিয়াতুত তাহতাবি আলাল মারাকি পৃ. ১৭৮, রদ্দুল মুহতার ১/৩৬২)
এ সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে এই হাদিস আছে। দাজ্জালের আবির্ভাব ও সে সময়ের ফিতনাসংক্রান্ত বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০ দিন অবস্থান করবে, প্রথমদিন এক বছর সমপরিমাণ দীর্ঘ হবে, দ্বিতীয়দিন এক মাস সমপরিমাণ এবং তৃতীয়দিন এক সপ্তাহ সমপরিমাণ, আর বাকী দিনগুলো সাধারণ দিনসমূহের মতোই।’
সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এক বছর সমপরিমাণ দিনে কি আমাদের এক রাত-দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই যথেষ্ট হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, বরং তা সময় হিসাব করে পূর্ণ এক বছরের নামাজই আদায় করতে হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭, সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৪৩২১)
অস্বাভাবিক দেশসমূহে নামাজ-রোজা আদায়ের পদ্ধতি
যদি এমন হয় যে, দিন বড় হলেও সাহরি, ইফতারের সময় এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অল্প সময়ের জন্য হলেও নিয়মমাফিক পাওয়া যায়, তাহলে এর বিধান সাধারণ এলাকাসমূহের ন্যায়ই হবে। হ্যাঁ, যদি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উক্ত নিয়মমাফিক হয়েও দিন অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়ার কারণে রোজা রাখতে কঠিন সমস্যা হয়, তাহলে ওই মৌসুমে তারা রোজা ভেঙ্গে পরবর্তি স্বাভাবিক মৌসুমে সেগুলো কাজা করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে রোজা কাজা করার কারণে গুনাহ হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ১/৩৩৯, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া : ৪/১৪৫)
আর যদি লাগাতার কয়েকদিন সূর্য অস্ত না যায় তাহলে ২৪ ঘন্টা করে সময় ভাগ করে প্রথম ১২ ঘন্টাকে রাত ধরে দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শুরু হওয়ার দেড় ঘন্টা আগে সাহরি খেয়ে শেষ করে রোজার নিয়ত করে রোজা শুরু করে দিবে। দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শেষ হলে ইফতার করে মাগরিব, এশা, তারাবিহ নামাজ পড়ে নিবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/৩৩৯; আহসানুল ফাতাওয়া : ২/১১৩-১১৫)
আর যদি ২৪ ঘন্টায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হলেও নিয়মমাফিক না হয়, বরং সূর্যাস্তের পর ইফতার ও সাহরির সময় না পেতেই ফজরের সময় ও সূর্যোদয় হয়ে যায় তাহলে ওলামায়ে কেরাম সেখানে নামাজ-রোজা আদায়ের কয়েকটি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন:
এক. সে সব এলাকায় প্রতি ২৪ ঘন্টা সময় হিসেব করে তা ভাগ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, চাই পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পাওয়া যাক বা না যাক। রোজার ক্ষেত্রে তারা সেখানে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হওয়ার এতটুকু সময় পূর্বে ইফতার করে নিবে যেটুকু সময় জরুরত পরিমাণ খানা-পিনা করতে পারবে। এরপর তারা রোজার নিয়ত করে খানা-পিনা বন্ধ করে দিবে। তবে এক্ষেত্রেও এভাবে তাদের রোজা আদায় অধিক কষ্টকর হলে ওই সময় না রেখে পরবর্তিতে স্বাভাবিক সময়ে কাজা করে নিতে পারবে। আর মাগরিব, এশা ও বিতির নামাজ যথাক্রমে পড়ে নিবে। তারাবিহের সময় না পাওয়া যাওয়ায় তা না পড়লেও চলবে। (ফাতহুল কদির : ১/১৫৬, রদ্দুল মুহতার : ২/৪২০)
দুই. ওই সব এলাকায় যে মৌসুমে স্বাভাবিক সময় পাওয়া যায় ওই মৌসুমের শেষ দিন যে সময় ওই নামাজের সময় হয়, ওই সময়টাকেই অস্বাভাবিক দিনগুলোতে ওই নামাজের ওয়াক্ত হিসেবে গণ্য করে স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত নামাজ-রোজা আদায় করতে থাকবে।
তিন. তারা ওই দেশের পার্শ্ববর্তী নিকটতম দেশ যেখানে নিয়মিত সূর্য উদয়/অস্ত হয়, সেখানকার সময় অনুযায়ী নিজ দেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং প্রতিদিনের রোজা রাখবে। এই মত অনুসারেই ‘রাবেতাতুল আলমিল ইসলামী’ একটি সুপারিশও করেছে, এ মর্মে যে, তারা ৪৫ অক্ষাংশের যেকোনো একটি এলাকার সময়সূচীকে মানদণ্ডরূপে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী তাদের নামাজ-রোজা আদায় করলে ইনশা আল্লাহ আদায় হয়ে যাবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/১৭৩, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৬/৩৭৬-৩৭৮