দিনের বেলায় খুব একটা দেখা না গেলেও সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই জেগে উঠে পাবনার সব অবৈধ বালুমহলগুলো। তারপর সারারাত ধরে চলে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। যত্রতত্র ভাবে বালু তোলার কারণে প্রতি বছর নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় চলা বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। বরং উল্টো প্রশাসনের বিরুদ্ধেই বালুখেকোদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে বালু উত্তোলন চললেও এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে ও এলকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা নদীর পাবনার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর, দোগাছী ইউনিয়নের চর বলরামপুর, ভাঁড়ারা ইউনিয়নের দড়ি ভাউডাঙ্গি, চরতারাপুর ইউনিয়নের দিঘী গোয়াইলবাড়ি, শুকচর, সুজানগর উপজেলার চর ভবানীপুর, বরখাপুর, উদয়পুর, হাট মালিফা, নাজিরগঞ্জ, সাগরকান্দি, বেড়া উপজেলার ঢালারচর, নগরবাড়ি, চাকলা, ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী, লক্ষীকুণ্ডা এলাকাসহ জেলার অন্তত ২০টি পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। বালুবাহী ট্রাকগুলো জেলা শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের সামনে দিয়েই বাধাহীনভাবে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সম্প্রতি কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও শুরু হয়েছে। কৌশল পাল্টিয়ে এখন দিনের বদলে রাতে তোলা হচ্ছে বালু। আগে এইসব বালু মহলে নেতৃত্ব দিতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, ৫ আগস্টের পর তারা পালিয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় চলছে বালু উত্তোলন।
স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, প্রতিদিন একেকটি পয়েন্টে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বালু বিক্রি হয়। সবমিলিয়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার বালু বিক্রি হয়। বালু বিক্রির টাকার একটি অংশ চলে যায় স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন মহলের পকেটে। ফলে মাঝে মধ্যে জেলা বা উপজেলা প্রশাসন দু’একটি লোক দেখানো অভিযান চালালেও বেশিরভাগই থাকে নজরের বাইরে।
ভুক্তভোগী চর ভবানীপুর এলাকার কৃষক সাঈদ প্রামাণিক, এস্কেন্দার হোসেন, চর বলরামপুর গ্রামের শাহজাহান মল্লিক, কেরামত আলীসহ নদীপারের অন্তত দশজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আগে নদী শুকিয়ে গেলে সেখানে বাদামসহ আমরা ফসল আবাদ করতাম কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পারছি না। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বালু উত্তোলন শুরু হয়। ফসলি জমি নষ্টের পাশাপাশি রাস্তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। কিছু বলতে গেলেই দেয়া হয় হুমকি। আমরা প্রশাসনকে বললে তারাও কোনো পদক্ষেপ নেয় না। পুলিশ-প্রশাসনই যদি তাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরা কোথায় যাবো।
দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, এটা তো বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এখন হয়তো লোকালি ওরা করে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তো হচ্ছে না। এ বিষয়ে এতো ব্যস্ত হওয়ার কি আছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে কি বালু তোলা হয় নাই? তখন কি সাংবাদিকরা নিউজ করেছে? তখন কোথায় ছিল তারা? তারপরও এগুলো তো প্রশাসন দেখে, আমরা হয়তো ওইভাবে দেখি না বা করিও না।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আপনার মাধ্যমেই জানলাম। এছাড়া দুই-একটা মাধ্যমেও শুনেছি যে রাতে বালু তোলা হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছি। তারা ইতিমধ্যে কয়েকটি মোবাইল কোর্ট করেছে এবং আরও মোবাইল কোর্ট অব্যাহত থাকবে।
নিজেদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাবনা পুলিশ সুপার মোরতোজা আলী খান বলেন, এটা তো লোকজনের বক্তব্য। আপনাদের এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও নৌ-পুলিশকে ধরতে হবে। এসব বিষয়ে মূল কাজটা ওদের। অভিযানের জন্য যদি জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে যখন আমাদের কাছে ফোর্স চায়, আমরা ফোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু আমার জানা মতে, আগে যেভাবে বালু উত্তোলন হতো, এবার তা হচ্ছে না।