মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন—যার হাতের ছোঁয়ায় জন্ম নেয় শিল্পের নতুন ভাষা। কখনো ক্যালিগ্রাফি, কখনো পেন্সিল স্কেচ—প্রতিটি শিল্পকর্মেই ফুটে ওঠে তার নিখুঁত নান্দনিকতা। একসময় কেবল শখ হিসেবে শুরু করলেও, এখন এই শিল্প ধীরে ধীরে পেশায় পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী বোরহান ক্যালিগ্রাফির জগতে হয়ে উঠছেন একটি পরিচিত নাম। ইতিমধ্যে তার হাতে সৃষ্ট নান্দনিক শিল্পসমূহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
চারদিনব্যাপী একটি ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ২০২০ সালে বোরহানের ক্যালিগ্রাফি যাত্রা শুরু। তবে তারও আগে, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মানুষ আঁকার চেষ্টা থেকেই তার শিল্পভ্রমণ শুরু হয়। পেন্সিল স্কেচে হাত পাকানোর পর ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফির প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। এ যাত্রায় বোরহানকে সাহস জুগিয়েছেন তার ওস্তাদ জিহাদ বিন ফয়েজ। শুধু সাহসই নয়, পাশাপাশি শিখিয়েছেন—কীভাবে শিল্পকে খুব সহজে সৃজনশীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বোরহান বলেন, “আগে বইয়ের কভার বা ক্যালেন্ডারে ফন্ট ডিজাইন দেখে সেগুলো কপি করতাম। যারা শিল্প ভালোবাসে, তারা ক্যালিগ্রাফিকে না ভালোবেসে থাকতে পারে না। এটিকে শিল্পের ভাষায় বলা হয় ‘পিউরেস্ট ফর্ম অব আর্ট’।”
তার শিল্পচর্চার পেছনে রয়েছে এক গভীর অনুপ্রেরণা। একবার একজন তাকে বলেছিল—“তুমি তো মাদ্রাসার বারান্দায়ও যাওনি, তুমি আরবি ক্যালিগ্রাফি লিখতে পারবে?” এই কথাই তাঁকে তাড়িত করে। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেন, “মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড না হয়েও আমি ক্যালিগ্রাফি শিখে দেখাবো।”
বোরহানের প্রথম ক্যালিগ্রাফি ছিল কালেমা ‘শাহাদাত’ দিয়ে। এরপর একে একে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাম। ক্যাম্পাস এবং বন্ধুমহলে এখন তিনি একজন জনপ্রিয় শিল্পী।
বর্তমানে তিনি চারকোল ডেমোনস্ট্রেশন, ক্যালিগ্রাফি ও ডিজিটাল কনসেপচুয়াল ক্যালিগ্রামের কাজ করছেন। ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-পরবর্তী সময়ে তার ডিজিটাল কনসেপচুয়াল ক্যালিগ্রাফি ফেসবুকে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। গ্রাফিতি প্রজেক্ট, নতুন গ্রুপ গঠন এবং গাইডলাইন তৈরিতে তিনি তখন সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি বলেন, “মডার্ন ক্যালিগ্রাফির প্রতি আমার ঝোঁক প্রবল। কারণ, আমি চাই ক্যালিগ্রাফিকে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে এনে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। এটি যেন হয় বিভেদহীন এক বৈশ্বিক শিল্প।”
২০২২ সালে বোরহানের কিছু ক্যালিগ্রাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে—ফুটবল জাদুকর মেসি কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে করা ক্যালিগ্রামে মুগ্ধ হন হাজার হাজার মানুষ।
তবে শুধু আর্ট নয়, বোরহানের লক্ষ্য আরও বিস্তৃত। ভবিষ্যতে নিজের শিল্প প্রদর্শনী আয়োজনের স্বপ্ন দেখেন তিনি। তবে বর্তমানে নিজেকে প্রস্তুত করাই তার প্রধান লক্ষ্য।
পেশাগতভাবে শিল্পকে এগিয়ে নিতে বোরহান ও তার এক বন্ধু মিলে চট্টগ্রামের চকবাজারে শুরু করেছেন ‘ক্যালোস একাডেমি’। সেখানে ক্যালিগ্রাফি শেখানোর পাশাপাশি নতুন শিল্পী গড়ার কাজও করছেন সমানতালে।
প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ মিনিট ক্যালিগ্রাফির অনুশীলনে সময় দেন বোরহান। তার বিশ্বাস, ‘সবাই সবকিছুর মূল্য বুঝবে না। নিজের শিল্পকে আগে প্রাধান্য দিতে হবে। শিল্পচর্চায় ধৈর্য, পরিশ্রম আর ভালোবাসা—এই তিনটিই সবচেয়ে জরুরি।’
নতুন শিল্পীদের উদ্দেশে বোরহান বলেন, “টাকা নেই, সময় নেই—এই অজুহাত দিয়ে শিল্প শেখা যায় না। কেবল একটা পেন্সিল আর কাগজ দিয়েও শুরু করা সম্ভব। তবেই একদিন নিজেকে বড় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।”
উদীয়মান এই শিল্পী তার কাজের মাধ্যমে কেবল শিল্প রচনা করছেন না, বরং সৃষ্টি করছেন নতুন ভাবনা, আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণার পথ।