জানাজার নামাজে কাতারবন্দী মুসল্লিরা। সামনে খাটিয়ায় শায়িত মরদেহ। হঠাৎই মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা হাতে ধরা ছোট বোতল থেকে চিড়িক চিড়িক শব্দ তুলে ছেটাতে থাকেন গোলাপজল। কারও গায়ে, কারও কাঁধে, আবার কখনও সরাসরি মরদেহের গায়ে। চট্টগ্রামে ধর্মীয় যে কোনো রেওয়াজ-অনুষ্ঠানে এই গোলাপজল ছিটানো ছিল বহুদিনের রীতি। সুগন্ধ ছড়ানোই যার মূল উদ্দেশ্য।
যদিও সেই গোলাপজলে নেই গোলাপের কোনো নির্যাস। বোতলভর্তি তরল কেবল নানারকম রাসায়নিকের মিশেল। সময়ের পালাবদলে পারফিউম আর বডি স্প্রের ভিড়ে সেই গোলাপজল ধর্মীয় আচার থেকে অনেকটা হারিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে বিরিয়ানির পাতেই! সুগন্ধি খাবারের মোহে মানুষ অজান্তেই গিলছেন গোলাপজল নামের ওই ‘বিষ’।
এত অভিযান, তবুও অনিয়ম: জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত রেস্তোরাঁ-হোটেলে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহানগর অফিস ৪০টি এবং জেলা অফিস ২৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে। যেগুলোর বেশিরভাগই হোটেল-রেস্তোরাঁ। এসব অভিযানে বহু রেস্তেরাঁ-হোটেলকে জরিমানা-সতর্ক করা হয়। মহানগরের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলাও করা হয়। পাশাপাশি সংস্থাটি সচেতনতা বাড়াতে খাদ্য কর্মীদের নিয়ে দুটি কর্মশালা, ৬টি উঠান বৈঠক, ১টি স্কুল প্রোগ্রাম ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ২৭০টি দেয়ালিকা টাঙায়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও নগর ও জেলায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে জেলা কার্যালয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২০২টি অভিযান পরিচালনা করে ২৭৬টি প্রতিষ্ঠানকে ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে। আর সর্বশেষ জুলাই ও আগস্ট মাসে ৫৯টি অভিযান চালিয়ে ৭১টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেকই হলো হোটেল-রেস্তোরাঁ। আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় এই ১৪ মাসে ৬২৮টি অভিযান চালিয়ে ৬৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫০০ টাকা জরিমানা করে। এই সময়ে ৫৭টি সচেতনতামূলক সভা ও গণশুনানিও করে প্রতিষ্ঠান দুটি।
খাবারে গোলাজল-কেওড়া জল: চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁ থেকে হোটেল-সবখানেই এখন খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে গোলাপজল ও কেওড়া জল। এই মাসে নগরীর চারটি রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চারটিতেই খাবারে গোলাপজল ও কেওড়া জলের অস্তিত্ব পেয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাবারে গোলাপজল ও কেওড়া জল ব্যবহার করায় জিইসি মোড়ের কাচ্চি ডাইন রেস্তোরাঁকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকার হান্ডি ও ধাবা নামের দুটি রেস্তোরাঁকেও একই অপরাধে আড়াইলাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার। সর্বশেষ গত রবিবার নগরের বহদ্দারহাট এলাকার বিসমিল্লাহ ওরশ বিরিয়ানি ও মেজ্জান নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে একই কারণে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
গোলাপজলের পুরোটাই রাসায়নিক : গোলাপজল-কেওড়া জল কোনোভাবেই খাবারে ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের নিরাপদ খাদ্য অফিসার মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম।
তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, “খাবারের মধ্যে যদি ফুড এডিটিভস (খাদ্য সংযোজন) যুক্ত করতে হয় তাহলে সেটি হতে হবে অনুমোদিত। কিন্তু গোলাপজল-কেওড়া জল কোনোভাবেই খাবারের জিনিস নয়, এটি ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এটা খাবারে ব্যবহার করছেন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে। মানুষও সেসব খেয়ে মনে করছেন-‘আহ কি সুগন্ধি, বাবুর্চিটা দারুণ রান্না করেন’। কিন্তু তারা যদি জানতো এটার ক্ষতিকর দিক-তাহলে মুখেও নিতেন না। এটা পুরোটাই বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশেল। আর এটার গায়েও তাই লেখা থাকে।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘খাবারে গোলাপজল-কেওড়া জল নামের রাসায়নিক ব্যবহার এখন রীতি হয়ে গেছে। অথচ খাদ্যপণ্যে এই ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ব্যবসায়ীরা এলাচ-দারুচিনির পরিবর্তে সুগন্ধি হিসেবে এটা ব্যবহার করে আসছেন, কারণ এটা সস্তা। কিন্তু এসব উচ্চমাত্রার সিনথেটিক কেমিক্যাল মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এই রাসায়নিক সেবনে পেটের গ্যাস্ট্রিক ও হজমজনিত সমস্যা, লিভার ও কিডনির ওপর প্রভাবসহ প্রাণঘাতী রোগের সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য আমরা রেস্তোরাঁয় তদারকির সময় এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ভোক্তারা টাকা দিয়ে খাবার খান। কিন্তু রেস্তোরাঁ মালিকেরা তাদের খাওয়াচ্ছেন গোলাপজল-কেওড়া জল নামের রাসায়নিক। এভাবে বিষ খাইয়ে ভোক্তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছেন তাঁরা। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনও।
তবে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি ইমতিয়াজ উদ্দিন নওশাদ জানিয়েছেন, এখন ৯০ শতাংশ রেস্তোরাঁতে গোলাপজল-কেওড়া জল ব্যবহার করে না। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘রেস্তোরাঁয় নয় যেখানে এসব জিনিস উৎপাদন হয় সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা দরকার। আর আমাদের ভুলত্রæটি থাকলে অবশ্যই জরিমানা করবে। কিন্তু আমরা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও তো দেশের রাজস্ব খাতে অবদান রাখছি। কিন্তু যেভাবে সংস্থাগুলো গণমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে এসে অভিযান পরিচালনা করেন, তাতে আমাদের ব্যবসার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। কেননা যেটা নয় সেটিও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এতে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে।’