Search
Close this search box.

সন্ত্রাসীদের টার্গেট ব্যবসায়ীরা, নেপথ্যে কারা

৫ আগস্টের পরেও স্বস্তি ফেরেনি চট্টগ্রামের রাউজানে। বরং দিন দিন আতঙ্ক বেড়েই চলছে এই জনপদে। শান্তিতে নেই রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। সাধারণ মানুষের চোখের ঘুমও হারাম হয়ে গেছে সন্ত্রাসীদের দাপটে। রাজনৈতিক কারণে যেমন এখানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড তেমনি ব্যবসায়ীরাও হচ্ছেন সন্ত্রাসীদের টার্গেট। বালুমহাল দখল, মাটিকাটার নিয়ন্ত্রণসহ সব ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলছে প্রভাব বিস্তারের খেলা।
বিগত ১৬ বছর সবকিছুই সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ৫ আগস্টের পর তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে রাউজান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফজলে করিম যুগের অবসানের পর রাউজানে পরিপূর্ণ শান্তি ফিরবে-এমন আশা করেছিলেন সাধারণ মানুষ এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা। কিন্তু উলটো অশান্তি বেড়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকারের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা রাউজানকে অশান্ত করে তুলেছে। গত আট মাসে ১২ হত্যা ও অসংখ্য মারামারি, হামলা-পালটা হামলার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। দিনে কিংবা রাতে অজানা আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরেন এখানকার সাধারণ মানুষ। অনেকে আবার গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করছেন। যেভাবে ফজলে করিমের যুগে নিজ দলের অনেক নেতাকর্মীও যেতে পারেননি এলাকায়। আর মাঠ পর্যায়ে এই অশান্তির নেপথ্যে রয়েছেন কিছু চিহ্নিত টপটেরর। এদের কেউ গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরীর নামে কেউবা গোলাম আকবর খোন্দকারের নামে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে ডাবুয়ার আজিজুল হক, কদলপুরের ধামা ইলিয়াছ, নোয়াপাড়ার আবু তাহের, পূর্ব গুজরার বিধান বড়ুয়ার নাম আলোচনায় আছে। তারা গিয়াস কাদেরের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। অন্যদিকে নোয়াপাড়ার ফজল হক (সৌদি প্রবাসী), বাগোয়ানের মামুন ও পশ্চিম গুজরার ফরিদ গোলাম আকবরের অনুসারী হিসাবে পরিচিত।
সূত্র জানায়, এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রাউজানের অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাসহ এক বা একাধিক মামলা রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে এদের কেউ এলাকা ছাড়া, কেউ বিদেশে, কেউবা কারাগারে থাকলেও ৫ আগস্টের পর তারা এলাকায় ফিরেছেন। দল-বল ও অনুসারীদের নিয়ে চালাচ্ছেন হামলা-পালটা হামলা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাকর্মীদের। রাউজান যে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে এটি স্বীকার করছেন এখানকার শীর্ষ দুই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী এবং গোলাম আকবর খোন্দকারও। তবে এই পরিস্থিতির জন্য তারা দুজন পরস্পরকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে কেন্দ্র থেকে শোকজ পেয়েছেন গিয়াস কাদের চৌধুরী। অন্যদিকে গোলাম আকবরের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছেন গিয়াস কাদের। দুই নেতা আগামীতে রাউজানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাই এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কিংবা নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চান তারা।

সূত্র জানায়, রাউজান থেকে ছয়বারের এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাউজান থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েও আড়াই বছর নিজ এলাকায় যেতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে এলাকা ছাড়া ছিলেন তার অনুসারী নেতাকর্মীরাও। ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়ে সেই প্রতিশোধই নেন ফজলে করিম। সেইবার এলাকা ছাড়া হন বিএনপির নেতারা। এমনকি ভিন্নমত পোষণকারী নিজ দলের নেতাদেরও এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাউজানে নতুন করে আবির্ভূত হন বিএনপির পুরোনো ও প্রভাবশালী দুই নেতা-গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবরের অনুসারীরা। এর মধ্যে রয়েছেন এক সময়ের চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও। তাদের কেউ গিয়াস কাদের কেউ গোলাম আকবরের নামে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। উপজেলার লাম্বুর হাট, কচুখাইন, ডাবুয়া, হলুদিয়ায় বালুমহালের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও দখল নিয়ে বিরোধে জড়ান তারা। কর্ণফুলী ও হালদার রাউজান অংশে বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়ান। গত ৮ মাসে যে ১২ জনের প্রাণ গেছে এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের চারজন, যুবদলের তিনজন, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী তিনজন ও দুজন প্রবাসী। এসব ঘটনায় ৯টি মামলা হয়েছে। দুটিতে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে ভয়ে মামলাও করা হয়নি। এমন পরিস্থিতির জন্য বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদেরকে দায়ী করেছেন উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকার।

তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাউজানে যেসব খুন-খারাবি হয়েছে সেজন্য গিয়াস কাদের দায়ী। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বাড়ি ভাঙচুরসহ যে অরাজকতা চালানো হচ্ছে তার জন্য দলের হাইকমান্ড সুনির্দিষ্ট অভিযোগে এরই মধ্যে তাকে শোকজ করেছে। যারা খুন হচ্ছে তারা যেমন গিয়াস কাদেরের লোক, যারা খুন করছে তারাও তারই লোক। চাঁদাবাজির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই নিজেরা খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছেন।

অপর দিকে রাউজানে সাম্প্রতিক অশান্তির জন্য গোলাম আকবরকে দায়ী করে গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী বলেন, রাউজানে গত আট মাসে যে ১২টি হত্যা হয়েছে তার মধ্যে আটটিই রাজনৈতিক এবং হত্যার শিকার ব্যক্তিরা আমার অনুসারী। গোলাম আকবর আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্ট আমলের সন্ত্রাসীদের নিয়ে আমার ছেলেদের হত্যা করছে। নিজে এলাকায় যেতে পারে না অথচ বাইরে বসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এটা অসহনীয়। আমি রাউজানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছি। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, রাউজানের একটি অংশ পাহাড়ি ও রাঙামাটি সীমান্ত এলাকা। এখানে অপরাধ করে অনেক সময় অপরাধীরা পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এ কারণে তাদের গ্রেফতার করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। এর পরও সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। একাধিক হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। রাউজানকে শান্ত করতে যত ধরনের উদ্যাগ নেওয়া প্রয়োজন আমরা নেব