৫৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার নিজস্ব অর্থে চীন থেকে দুটি জাহাজ কিনছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)। ৫৫ থেকে ৬৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার নতুন দুটি কার্গো জাহাজ দিয়ে বছরে বিএসসির আয় হবে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি তৈরি হবে নাবিকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ।
মঙ্গলবার (১২ জুলাই) দুটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম জাহাজ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয় জাহাজ নভেম্বর মাসে বিএসসিকে হস্তান্তর করা হবে।
এক সময় দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক পতাকাবাহী জাহাজের মালিক ছিল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। নব্বইয়ের দশকে বহরে ছিল ৩৪টি জাহাজ। কিন্তু পুরনো জাহাজ কেনা, অনিয়ম, আর দুর্নীতির কারণে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়েছে এই বহর।
২০১৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন ৬টি জাহাজ পেয়ে লাভের ধারায় ফিরলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বাংলার সমৃদ্ধি নামে একটি জাহাজ হারায় বিএসসি। সবশেষ গত বছর অগ্নি দুর্ঘটনায় দুটি অয়েল ট্যাংকার পরিত্যক্ত হলে বিএসসির জাহাজ কমে দাঁড়ায় পাঁচটিতে।
২০১৮ সালে চীন থেকে চারটি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া চললেও নানা জটিলতায় হয়নি ঋণচুক্তি। তাই এক বছর আগে প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থে জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এতে ব্যয় হবে ৯০০ থেকে ৯৫০ কোটি টাকা। ৫৫ থেকে ৬৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি বাল্ক কার্গো জাহাজ সরবরাহে দরপত্র দাখিল করেছে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান।
কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি কেনাকাটায় নানা ধাপ ও ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয় থাকায় দরপত্রে অংশ নিতে চায় না অনেক প্রতিষ্ঠান। তারপরও আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাহাজ কেনার চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আশাবাদী বিএসসি। দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ কম থাকায় পণ্য পরিবহনে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বাইরে। নতুন দুটি জাহাজ দিয়ে বছরে ১৫০ কোটি টাকা আয়ের প্রত্যাশা কর্তৃপক্ষের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা ৬৩,৫০০ ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি) এবং মোট ক্রয়মূল্য হবে প্রায় ৭৬.৬৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্যের তুলনায় ৪.৬০ শতাংশ কম। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৯৩৫ কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। জাহাজ দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুন থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য এর ডিপিপি গত ৩ জুন অনুমোদিত হয় এবং অনুমোদন মোতাবেক এর প্রাক্কলিত ব্যয় ১১৬২ কোটি ৯৬ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা।
ইতোমধ্যে জাহাজ ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক এক ধাপ দুই খাম (One Stage Two Envelope Tendering Method-OSTETM) পদ্ধতিতে গত ৪ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৬ জুলাই। মোট ৮টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে।
প্রস্তাবগুলোতে প্রাপ্ত জাহাজসমূহের বিভিন্ন কারিগরি বিষয়াদি যাচাই-বাছাই করা হয় এবং মূল্যায়ন কমিটি সরেজমিনে জাহাজ দুইটির নির্মাণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। জাহাজের স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত এবং জাহাজের কারিগরি মূল্যায়নে Classification Society(s)-এর প্রতিনিধির বিশেষজ্ঞ সেবা গ্রহণ করা হয়।
কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি (Hellenic Dry Bulk Ventures LLC) এর প্রস্তাবিত চীনে তৈরি প্রতিটি জাহাজের একক মূল্য ৩৮.৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দুটি জাহাজের মোট সমন্বয়কৃত ও সুপারিশকৃত মূল্য ৭৬.৬৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্য ৮০.৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে ৪.৬০% কম। বাংলাদেশি টাকায় একেকটি জাহাজের মূল্য প্রায় ৪৬৭ কোটি টাকা।
মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি এর প্রস্তাবিত ৬৩,৫০০ ডিডব্লিউটি সম্পন্ন জাহাজ দুটি সুপারিশ করার কারণ হলো তাদের প্রস্তাবিত জাহাজগুলোর বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক জানান, জাহাজ দুটি চালুর পর বিএসসির নিজস্ব পরিবহন সক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ডিডব্লিউটি বৃদ্ধি পাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম জাহাজ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয় জাহাজ নভেম্বর মাসে বিএসসিকে হস্তান্তর করা হবে। নতুন দুটি কার্গো জাহাজ দিয়ে বছরে বিএসসির আয় হবে আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। একইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি তৈরি হবে নাবিকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ।