মোহাম্মদ ইউছুপ:
ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ যা সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এটি কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংসতা নয়, বরং পুরো সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধর্ম ও বিজ্ঞান ধর্ষণের কারণ, প্রতিকার এবং এর প্রতিরোধের বিষয়ে আলোচনা করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণ
ইসলাম ধর্ষণকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং এটি ব্যভিচারের চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হয়েছে।
কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা:
-
আল্লাহ বলেন:
“আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল ও মন্দ পথ।” (সুরা আল-ইসরা: ৩২)
-
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
“যদি কোনো ব্যক্তি অপরের সম্মতি ছাড়া তার সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সে অপরাধী এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।” (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামে শাস্তির বিধান:
ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, ধর্ষণের শাস্তি হলো কঠোর দণ্ড, যার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, শারীরিক শাস্তি (তলোয়ার বা চাবুক দ্বারা দণ্ড), অথবা সমাজ থেকে বহিষ্কার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
খ্রিস্টধর্মের দৃষ্টিতে ধর্ষণ
খ্রিস্টধর্মেও ধর্ষণকে গুরুতর পাপ ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাইবেলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ এবং এটি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
বাইবেলের নির্দেশনা:
-
ইহুদিদের আইন (পুরাতন নিয়ম – ওল্ড টেস্টামেন্ট)
“যদি কোনো পুরুষ কোনো কুমারী মেয়েকে ধর্ষণ করে, তবে তাকে অবশ্যই সেই নারীর স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং তার বাবাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।” (গণনাপুস্তক ২২:২৮-২৯)
-
নতুন নিয়ম (নিউ টেস্টামেন্ট)
“নিজের প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান দেখাও, নারীদের প্রতি দৃষ্টিতে সততা রাখো এবং অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকো।” (মথি ৫:২৮)
খ্রিস্টধর্মে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে বিশুদ্ধ জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে।
হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে ধর্ষণ
হিন্দুধর্মে ধর্ষণকে গুরুতর পাপ ও অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করার নির্দেশনা রয়েছে।
মনুসংহিতায় নির্দেশনা:
-
নারীর সম্মান রক্ষা করা পুরুষের কর্তব্য:
“যেখানে নারীদের সম্মান করা হয়, সেখানে দেবতারা আনন্দিত হন। যেখানে নারীদের অসম্মান করা হয়, সেখানে শুভ কাজ কখনোই ফলপ্রসূ হয় না।” (মনুসংহিতা ৩:৫৬)
-
ধর্ষণের শাস্তি:
“যদি কোনো ব্যক্তি নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে, তবে তাকে কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত।”
হিন্দুধর্মে ধর্ষণকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং অপরাধীকে সমাজচ্যুত করার বিধান রয়েছে।
বৌদ্ধধর্মের দৃষ্টিতে ধর্ষণ
বৌদ্ধধর্মে ধর্ষণকে গুরুতর অনৈতিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা একজন ব্যক্তির আত্মার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে।
বৌদ্ধধর্মের পাঁচটি নৈতিক শিক্ষা:
১. হত্যা করো না
২. চুরি করো না
৩. ব্যভিচার করো না (এখানে ধর্ষণ অন্তর্ভুক্ত)
৪. মিথ্যা বলো না
৫. নেশাগ্রস্ত হয়ো না
বৌদ্ধ ধর্মমতে, ধর্ষণ কেবল সামাজিক অপরাধই নয়, এটি ব্যক্তির আত্মিক শান্তির পরিপন্থী।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধর্ষণ
বিজ্ঞান ধর্ষণকে মূলত মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
মানসিক কারণ:
- মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যা: অনেক ধর্ষক মানসিকভাবে বিকৃত চিন্তাভাবনা ধারণ করে এবং তাদের মধ্যে সহিংস প্রবৃত্তি থাকতে পারে।
- শিশুকালীন ট্রমা: যেসব শিশু ছোটবেলা থেকে নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- অশ্লীল কন্টেন্ট: পর্নোগ্রাফির অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মানুষের চিন্তাভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক কারণ:
- নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি: অনেক সমাজে এখনো নারীদের অধীনস্ত ভাবা হয়, যা ধর্ষণের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
- আইনের দুর্বল প্রয়োগ: অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
ধর্ষণ থেকে মুক্তির উপায়
ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনগত উদ্যোগ প্রয়োজন।
১. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রচার করা
- শিশুদের ছোটবেলা থেকেই নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে।
- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ সৃষ্টি করতে হবে।
২. আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা
- দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ধর্ষণের মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত।
- ধর্ষণের শাস্তি কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে, যাতে অপরাধীরা ভয় পায়।
৩. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা
- ধর্ষণবিরোধী ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা আয়োজন করা।
- নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ষণ প্রতিরোধমূলক শিক্ষা চালু করা।
উপসংহার
ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে হলে ধর্ম, সমাজ, আইন ও বিজ্ঞানের যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। প্রত্যেক ধর্ম ধর্ষণকে নিষিদ্ধ করেছে এবং বিজ্ঞানও একে মানবিক ও সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে।