জুলাই বিপ্লবে শহীদ ১২১ বেওয়ারিশ লাশের পরিচয়ের খোঁজে নেমেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ-সংলগ্ন কবরস্থানে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ১১৪ লাশ দাফন করা হয়। আর ৭টি বেওয়ারিশ লাশ এখনো পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। তাদের পরিচয় এখনো খুঁজে বের করা যায়নি।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি কবরস্থান এবং আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তালিকায় দেখা যায়, শুধু জুলাইয়ে ৮০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় এ কবরস্থানে। ২২ ও ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১১টি করে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। ১ জুলাই দাফন করা হয় ১০টি, ২৪ জুলাই ৯টি, ৮ ও ২৭ জুলাই ৭টি করে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বধ্যভূমি কবরস্থানের চার নম্বর ব্লকের ৩৭ নম্বর লেনে বেওয়ারিশ লাশগুলো দাফন করা হয়।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কবরগুলোতে লেখা রয়েছে- ‘এই কবরগুলোতে যারা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাদের সবার পিতৃপরিচয় ছিল, ছিল তাদের পরিবার; কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের কারণে তারা আজ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলো। তারা তো বেওয়ারিশ ছিলেন না’।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার এসএম মইনুল করিম বলেন, বেওয়ারিশ প্রতিটি লাশের ডিএনএ নমুনা এবং ছবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রাখা হয়েছে। আপনাদের মাধ্যমে আমরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাশ শনাক্তের আহ্বান জানাই। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহীদ রফিকুল ইসলামের পরিবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের দাবি যাচাই-বাছাই চলছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মকর্তারা জানান, তারা রায়েরবাজার কবরস্থানে জুলাইয়ে ৮০ এবং আগস্টে ৩৪ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছেন। তবে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া কতজন আন্দোলনে গিয়ে মারা গেছেন, তা তারা নিশ্চিত নন। সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী, অর্ধেকের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ ছিলেন এবং বাকিরা ছিলেন আঘাতপ্রাপ্ত।
সংস্থাটির হিসাবে দেখা যায়, জুলাইয়ে প্রাপ্ত বেওয়ারিশ লাশগুলো বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তাদের কাছে আসে। এর মধ্যে ১ জুলাইয়ের ১০টি লাশই আসে ঢাকা মেডিকেল থেকে। ২২ জুলাইয়ের ১১ লাশের ৯টি আসে ঢাকা মেডিকেল এবং দুটি আসে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল থেকে। ২৫ জুলাইয়ের ৩টি লাশের সবগুলোই আসে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল মর্গ থেকে। ৩১ জুলাই বেওয়ারিশ ৩টি লাশ আসে মিটফোর্ড মেডিকেল মর্গ থেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একজন কর্মকর্তা জানান, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় আগত লাশগুলো দ্রুত দাফন করার জন্য সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী আমাদের ক্রমাগত চাপ দিয়েছিল। ফলে আমাদের পক্ষ থেকে তাদের পরিচয় উদ্ধারে অপেক্ষা করা বা খোঁজ নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশন সূত্র জানায়, বেওয়ারিশ লাশগুলোর মধ্যে ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে মারা যাওয়া আনুমানিক ৪০ বছরের পুরুষটির মাথা ও শরীরে ১০টি শটগানের গুলির আঘাত ছিল। একইভাবে ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসা আনুমানিক ২৮ বছরের যুবকের লাশটির বুকে ও শরীরে শটগানের আঘাত ছিল। এ ধরনের আরো ৬টি অজ্ঞাত লাশের ছবি রয়েছে, যাদের শরীরে গুলির আঘাত পাওয়া যায়।
বধ্যভূমি কবরস্থানের সংশ্লিষ্টরা জানান, এখনো বহু স্বজন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হতে ছুটে আসেন আমাদের কাছে। কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে একটু পরপর ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে একজন করে ‘বেওয়ারিশ’ লাশের কবর চিহ্নিত করা আছে। এর বাইরে কোনটি কার কবর বা অন্য কোনো চিহ্ন নেই। আওয়ামী সরকারের চাপে এবং তাড়াহুড়োয় সরকারি চাপে এটি করতে হয়েছে। তাই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এমন পরিবারের সদস্যরা শেষ পর্যন্ত ডিএনএ পরীক্ষার ওপর ভরসা করছেন।
বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ আহমেদ মারুফ জানান, নিখোঁজ ব্যক্তি বা এখনো অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি স্থায়ী সেল গঠন করা দরকার, যার মাধ্যমে প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তি ও অজ্ঞাত লাশের একটি অনলাইন ডেটাবেজ, যোগাযোগের নম্বরগুলো দেওয়া থাকবে। বিপ্লবের ৮ মাস পরও এতগুলো মানুষের পরিচয় না পাওয়া সত্যিকার অর্থে দুর্ভাগ্যের বিষয়।