৪৫ রুটে ঢুকে ইয়াবা, টেকনাফে সর্বনিম্ন দাম, ঢাকায় সর্বোচ্চ
সীমান্তে মিয়ানমারের ১৫০ কারখানা । চট্টগ্রামই পাচারের মূল রুট । ধরা পড়া পাচারকারীর ৮০ শতাংশ বাহক । মাদক প্রতিরোধে টাস্কফোর্স, ‘অ্যাকশন বেড়েছে বহু গুণ’
শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | মঙ্গলবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশকে টার্গেট করে কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফ এবং বান্দরবানের সীমান্ত কেন্দ্রিক ইয়াবা কারখানা গড়ে তুলেছে মিয়ানমার। ২০০৫ সালের দিকে ইয়াবা পাচারের সূচনা হয়। ২০০৬ সালে প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে ইয়াবার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। মিয়ানমারও ইয়াবার কারখানা বাড়িয়েছে বহু গুণ। বর্তমানে দেড় শতাধিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়েছে মিয়ানমার। উৎপাদিত ইয়াবার ৯০ শতাংশই পাচার করছে বাংলাদেশে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইয়াবার ভয়ংকর আগ্রাসন চলছে।
পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মাদকের জগতে ইয়াবা প্রধান ব্যবহৃত মাদক। এর নেটওয়ার্ট এখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। শহর থেকে পাড়া গাঁ সবখানে ভয়াল থাবা বসিয়েছে ইয়াবা। বড় লোকের ছেলে থেকে ভিক্ষুকের ছেলে পর্যন্ত এখন ইয়াবায় আক্রান্ত। পরিসংখ্যান মতে, পাচার, বিক্রি এবং বহন সহজলভ্য হওয়ায় এবং দাম কমে যাওয়ায় ইয়াবার আগ্রাসন দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।
কম দামে হাতের নাগালে মিলে ইয়াবা : স্বাভাবিকভাবে মিয়ানমারের কারখানা থেকে প্রতি পিস ইয়াবা ক্রয়মূল্য পড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তবে বেশিরভাগ আসে কারখানা মালিক ও কারবারিদের মধ্যে অংশীদারী ভিত্তিতে। অন্যদিকে টেকনাফে সর্বনিম্ন এবং রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয় ইয়াবা। ‘ইয়াবার দাম ও পাচারের রুট সম্পর্কিত তথ্য’ শিরোনামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০২৩ সালে চালানো এক জরিপ অনুসারে, পাইকারি ও খুচরায় ইয়াবার সর্বনিম্ন দাম টেকনাফে। এখানে পাইকারিতে ৩০–৪০ টাকা এবং খুচরায় ৪০–৫৫ টাকায় প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি হয়। আর ঢাকায় ইয়াবার দাম সর্বোচ্চ। এছাড়া কক্সবাজার শহরে পাইকারিতে ৪০–৫৫ টাকা ও খুচরায় ৭০–১০০ টাকা এবং চট্টগ্রামে পাইকারিতে ৫০–৮০ টাকা ও খুচরায় ৭০–১৪০ টাকায় প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় পাইকারিতে ৮০–১১০ টাকা ও খুচরায় ১৫০–২৫০ টাকায় প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি হয়। এছাড়া দূরত্ব অনুসারে দেশের অন্যান্য জেলায় দামের তারতম্য রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ–পরিচালক সৌমেন মন্ডল জানান, ইয়াবার ওই দাম বর্তমানেও এই হারে আছে।
অন্যদিকে ইয়াবা প্রাপ্তিটা দিনে দিনে সহজলভ্য হয়ে উঠছে। বহন সহজলভ্য হওয়ায় হাত বাড়ালে মিলছে ইয়াবা। ইয়াবাসেবীরা পানের দোকান বা ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে পারে। এছাড়া খুচরা বিক্রেতারা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে।
সীমান্তে মিয়ানমারের ১৫০ ইয়াবা কারখানা : পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন ওপারে প্রথম দিকে ৩৫টি স্থানে ৩৭ ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা গড়ে উঠেছিল। তবে এক পর্যায়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠে কারখানা। বাড়তে বাড়তে সীমান্তের ৩টি জেলায় গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫০টি ইয়াবা কারখানা। মংডু, বুচিডং ও রাথেডং এলাকায় বেশি ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। ওই কারখানাগুলোতে ইয়াবা উৎপাদন হওয়ার পর চোরাকারবারিরা বাংলাদেশের সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে। উৎপাদন হওয়া ইয়াবাগুলো মাছ ধরা নৌকা, জর্দার কৌটা, বাঁশের ভেতরসহ নানা মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। সীমান্ত এলাকা থেকে ইয়াবার সঙ্গে আইসও আসছে। ইয়াবা কারখানার পাশাপাশি সীমান্তে আইসের কারখানাও গড়ে তুলেছে মিয়ানমার। তবে দামি হওয়ায় এর বিস্তার ইয়াবার মতো নয়।
যেভাবে ঢুকে, পাচার হয় : মিয়ানমারের কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার মূল বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সর্বত্র এই মাদক ছড়িয়ে দিতে স্থল ও সমুদ্র পথে ইয়াবার চালান বাড়ানোর রুটও বেড়েছে। ইয়াবা উৎপাদিত হওয়ার পর ৪২ থেকে ৪৫টি রুট দিয়ে কক্সবাজার অঞ্চলে প্রবেশ করে। তারপর একাধিক রুট হয়ে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। বর্তমানে সাগর পথ ও স্থল পথ মিলে চট্টগ্রামই ইয়াবা পাচারের মূল রুটে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ইয়াবা পাচারের অনেক চক্র রয়েছে। কক্সবাজারের সীমান্ত কেন্দ্রিক হলেও এসব চক্রের সাথে সারা দেশের পাচারকারী জড়িত রয়েছে। পাচারের চক্রে বিভিন্ন স্তরের লোকজন জড়িত। সীমান্তের ওপারে কারখানা কেন্দ্রিক পাচারকারীরা মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। তারা কারখানা থেকে সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাচারের ব্যবস্থা করে। প্রথম দিকে বাংলাদেশি কারবারিরা পাইকারি দামে কিনে আনত। বর্তমানে এই পদ্ধতি প্রায় ৯০ শতাংশ কমেছে। এখন মিয়ানামারের কারখানা মালিকের সাথে অংশীদারী ভিত্তিতে ব্যবসা করে বাংলাদেশি কারবারিরা। অর্থাৎ পাচার করে আনা ইয়াবা বিক্রি করেই কারখানা মালিককে টাকা দেয় কারবারিরা।
দেশের পাচারচক্রের মধ্যে রয়েছে কয়েক স্তরের লোক। এর মধ্যে গডফাদার থাকে মুখ্য ভূমিকায়। তাদের আশ্রয়ে পাচারের মুখ্য পাচারকারী, মধ্যম পাচারকারী এবং বাহক পাচারকারী থাকে। মুখ্য পাচারকারীর সাথে মিয়ানমারের থেকে পাচারকারীর যোগাযোগ রয়েছে। এদেশের মুখ্য পাচারকারী ইয়াবা চালানের সাথে সরাসরি জড়িত থাকে না। মধ্যম পাচারকারীর মাধ্যমে বড় বড় চালান দেশে ঢুকে এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারে ব্যবহৃত হয় বাহক। তারা চালান প্রতি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে এ কাজ করে। এই তালিকায় বেশিরভাগ রয়েছে জেলে। এছাড়া বেকার যুবক, নারী, কাঠুরিয়া, কৃষক, ফেরিওয়ালা, বিভিন্ন গাড়ির চালক–হেলপার, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজনও রয়েছে। মূলত বাহকের হাত ধরেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ইয়াবার চালান। এরা বিভিন্নভাবে চালান পাচার করে। রোগী বহনের কাজে নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স, মাছ, শাকসবজি, কাঠের ভেতরে, এমনকি জুতা, গ্যাস সিলিন্ডার, কাঁঠাল, কুমড়া, পেটের ভেতরে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। পাচারে মৌলভি, ভিক্ষু, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সাগর ও নৌ পথেও বিভিন্ন নৌযানে কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ হয়ে ইয়াবার চালান চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, ইয়াবা চালান নিয়ে ধরা পড়া পাচারকারীর অন্তত ৮০ শতাংশই বাহক। তারা ইয়াবা চালানের ভাগবাটোয়ারায় থাকে না। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে চালান সীমান্ত থেকে দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে দেয়। বাহকরা চালান পাচার করায় ইয়াবা কারবারিরা বেশিরভাগ ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
আইন–শৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, সীমান্ত কেন্দ্রিক ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক প্রতিরোধে সর্বোচ্চ পাহারা রয়েছে। বিজিবি, র্যাব, পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একযোগে কাজ করছে। মাদক প্রতিরোধে গতি আরো জোরদার করতে সম্প্রতি কক্সবাজারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ–পরিচালক সৌমেন মন্ডল বলেন, সম্প্রতি মাদকের চালান জব্দ হওয়া ঘটনা বেড়েছে। চালান বেশি ধরার পড়ায় পাচার বেড়েছে বলা হলেও এটা আবার উল্টো হতে পারে। ইয়াবাসহ সমস্ত মাদক রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এখন একযোগে কাজ করছে। সেই সাথে সম্প্রতি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। সব মিলে মাদকের বিরদ্ধে অ্যাকশন বেড়েছে বহু গুণ।
র্যাব–১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল ইসলাম বলেন, র্যাব–১৫ এর অধীনে শুধুমাত্র টেকনাফে চারটি কোম্পানি ক্যাম্পের আওতায় সাতটি টিম রয়েছে। এছাড়া উখিয়ায় একটি টিম রয়েছে। এসব টিম মাদক ও সন্ত্রাসী ধরতে সব সময় কাজ করে। প্রতিদিন একাধিক ইয়াবা চালান র্যাবের আভিযানিক দল জব্দ করে আটক করে কারবারিদের। আমরা জিরো টলারেন্স নিয়ে মাদক নির্মূলে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. মুহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক এবং অস্ত্র ও চোরাচালান প্রবেশ রোধে বিজিবি অতীতের চেয়ে এখন বহু গুণে সক্রিয় রয়েছে। ফোর্স বেড়েছে, পাহারা বেড়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে অভিযান চলছে। মাদকও আগের চেয়ে বেশি জব্দ হচ্ছে। পাচারকারীদের কোনোভাবে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।