চোখ দুটি বন্ধ। পুরো মাথা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। নাক-মুখে অসংখ্য ক্যানুলা। মাথার মাঝখান বরাবর কোপ পড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ সায়েম এখনও সংজ্ঞাহীন। জোবরা গ্রামের সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর হামলার শিকার এই শিক্ষার্থীর জ্ঞান ফেরেনি চারদিনেও। এই তরুণের ফেরার অপেক্ষায় নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বাইরে নির্ঘুম রাত কাটছে তার মা-বাবা, শিক্ষক আর বন্ধুদের।
সুস্থ-সবল ছেলেটির এই পরিণতির পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মোহাম্মদ নোমান নামের এক তরুণ ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। সায়েমের বন্ধু ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, এই নোমান আর তার সঙ্গীরাই কুপিয়েছে সায়েমকে। নোমানের বাড়ি ফতেহপুর ইউনিয়নে। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে জানা গেছে। ঘটনার দিন সংঘর্ষে অংশ নেওয়া নোমানের ছবি প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ফেসবুক পেজ ‘দ্য বিউটি অব সিইউ ক্যাম্পাস।’
শুধু নোমান নন, ওই পেজটি গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত নয়জনের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে, যারা সবাই ওইদিন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া চিহ্নিত না হওয়া প্রায় শতাধিক যুবকের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের নাম পরিচয়ের জন্য সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। চবির এক ছাত্রীকে ভাড়া বাসায় দারোয়ানের মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার রাত ও রবিবার দিনব্যাপী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই শিক্ষার্থী-স্থানীয় সংঘাতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে বেশিরভাগ চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।
সেদিন স্থানীয় সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর রামদা, কাস্তে, লোহার রডসহ নানা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। হামলার সময় ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি কোপাতে দেখা যায়। আক্রোশের এখানেই শেষ নয়, দু’জন শিক্ষার্থীকে মেরে ছাদ থেকে ফেলেও দেন সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান আব্দুর রহিম বাদী হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় ৯৫ জনের নামোল্লেখ ও এক হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর বাইরে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া ওই নয়জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য বিউটি অব সিইউ ক্যাম্পাস নামের পেজটি।
নয়জনের নাম-পরিচয়: নোমানের কথা তো আগেই বলা হলো। নাম-পরিচয় পাওয়াদের আরেকজন হলেন মো. ফয়সাল। ঘটনার দিন ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাকে রামদা নিয়ে কোপাতে দেখা যায়। এই যুবক আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখনকার বিভিন্ন ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরেকজনের নাম এমএইচ জনি। তিনি হাটহাজারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়েন। ঘটনার দিন এই তরুণ জোবরার ইমাম বুখারী গলিতে হামলায় অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই তরুণের ফেসবুক আইডিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রকাশ করা ওই আইডিতে আর ঢোকা যাচ্ছে না।
হামলার দিন বড় পাথর দিয়ে এক ছাত্রকে মাথায় থেঁতলাতে দেখা গেছে একদল যুবককে। সেই দলে ছিলেন মো. মাসুদ। ‘জোবরা ফ্রেন্ডস সার্কেল’ নামের একটি দলের সদস্য তিনি। তিনি একসময় উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলার সময় তাকে খুবই আগ্রাসী অবস্থায় দেখা গেছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর শনিবার রাতে সবার আগে হাত তোলার অভিযোগ উঠেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকের বিরুদ্ধে। ছবিতে হামলার সময় তাকে লাঠি হাতে দেখা গেছে, তবে তার নাম এখনও পাওয়া যায়নি। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম। তাকে কোপান কয়েকজন। তাদের মধ্যে রামদা হাতে কোপানো একজনের স্পষ্ট ছবি প্রকাশ হয়েছে। ঘটনার শুরুতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক মারধর করেন মো. মিজান নামের এক যুবক। পরদিনও তিনি হামলায় অংশ নেন।
হামলার সময় লোহার রড হাতে দেখা গেছে সাইফুল ইসলামকে। তিনিও ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। হামলার সময় রামদা হাতে একটি দলের নেতৃত্ব দেন মো. ফারুক নামের আরেক যুবক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানি, যে দোকানের ক্রেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। হামলায় অংশ নেওয়া এসব ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া হামলায় অংশ নেওয়া যাদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে তাদের ইতোমধ্যে আমরা শনাক্ত করেছি। এই ব্যক্তিদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি হামলায় কিছু ব্যক্তি মাস্ক পরে অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরও শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।