
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তিন শিশু। একে অপরের কাঁধে হাত। ঠোঁঠের কোণে মিষ্টি হাসি। ছেলে অরিত্র হাসান ও দুই ভাতিজার ছোটবেলার এই ছবি সাকিব হাসান পোস্ট করেছেন ‘ফেসবুকের ওয়ালে’। আর ছবির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদনাভরা সেই গান-‘কি করিলে বলো পাইব তোমারে…রাখিব আঁখিতে আঁখিতে…।’
এই অরিত্র হাসানকে চিনতে হলে ফিরে যেতে হবে ৮ জুলাইয়ের সেই মন খারাপের সকালে। ওই দিন কক্সবাজারের হিমছড়িতে বঙ্গোপসাগরে নেমে হারিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তিন বন্ধু। দুজনের নিথর দেহ মিললেও সাগর ফিরিয়ে দেয়নি অরিত্রকে। তারপর সময় গড়িয়েছে, মাস পেরিয়েছে, ঋতু বদলেছে। অরিত্রকে ভুলতে শুরু করেছেন সবাই। শুধু অপেক্ষার দহনে নিঃশব্দে পুড়েই চলেছেন সাকিব হাসান আর জেসমিন আক্তার, অরিত্রের শোকাকুল বাবা-মা।
একমাত্র ছেলেকে হারানোর পর প্রায় একমাস ধরে অরিত্রের বাবা-মা সাগরচরের প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি সাদা ফেনা, প্রতিটি গোধূলিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন। শেষমেশ প্রাণের টুকরোকে না পেয়ে বুকে পাথর বেঁধে তাদের ফিরে যেতে হয়েছে ঢাকায়। তবু মন রয়ে গেছে হিমছড়ির বালুকাবেলায়-যেখানে শেষবার ছুঁয়ে গিয়েছিল ছেলের নিঃশ্বাস। তারপর থেকে তাদের প্রতিদিনের জীবন যেন এক অবিরাম অপেক্ষার। সাড়ে তিন মাস কেটে গেছে, তবু বাবার চোখে আজও নিভেনি আশা। এখন প্রতিদিন ফেসবুকে নানা স্মৃতিচারণের পাশাপাশি সরকারের কাছে ছেলের খোঁজে দাবি তুলে ধরাই সাকিব হাসানের অনিবার্য সূচি।
রবিবার, ফেসবুকে সাকিব হাসান লেখেন একটি দীর্ঘ নিবেদন ‘সবিনয় নিবেদন’। সেটির প্রতিটি শব্দে ঝরে পড়ে এক অসহায় পিতার হাহাকার।
সাকিব হাসান লেখেন, ‘গত ২০ আগস্ট রামু থানায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে একটি নিখোঁজ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। কিন্তু দুইমাসের বেশি সময় পার হলেও নিখোঁজ জিডির সূত্র ধরে অরিত্র হাসানকে খুঁজে বের করার কোনো তৎপরতা সম্পর্কে আমি ও আমার পরিবার অবহিত নই।’
অরিত্র হাসান কোথাও না কোথাও ‘আছে’, বিশ্বাস বাবার। সেই আত্মপ্রত্যয় থেকে সাকিব হাসান বলেন, ‘যে কোন অবস্থাতেই হোক, এমনকি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ নিয়ে হলেও অরিত্র হাসান আছে।’
পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে যতদিন খোঁজ না পায় ততদিন অনুসন্ধান চলে দাবি করে সাকিব হাসান আরও বলেন, ‘সাগর যা নেয় তা আপনাতেই ফিরিয়ে দেয়-এমন সান্ত¡নামূলক আংশিক মিথ্যা তত্ত্ব থেকে বের হওয়া দরকার। যেভাবেই অরিত্র আছে সেভাবেই আমি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সবিনয় নিবেদন করছি। আমি মনে করি অরিত্র হাসানকে ফিরে পাওয়া মানে আমাদের সকল সন্তান ও পিতামাতার মুখে একফালি স্বর্গীয় আনন্দের নিখাদ হাসি ফুটে ওঠা।’
সেই স্ট্যাটাস শেয়ার করেন অনেকেই। তাদেরই একজন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি মো. আলাউদ্দীন মহসিন। তিনি বলেন, ‘এই আবেদন শুধু একজন পিতার নয়, পুরো দেশের প্রত্যেক সন্তানের নিরাপত্তার আহ্বান। অরিত্রের বাবার এই সংগ্রাম যেন অনেকের চোখ খুলে দেয়।’
সোমবার রাতেও সাকিব ছেলেকে নিয়ে লেখেন একটা কবিতা। সেই কবিতায় কান্না মিশিয়ে এই বাবা লেখেন-‘তোমাকে খুঁজি নিঃস্ব পাগলের মতো/ঘড়ির কাটার বিপরীতে/নিঃশব্দ আহ্নিক পথ ধরে দূরে/হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ওপারে।’
হিমছড়ির নোনা হাওয়ায় যেন ভেসে বেড়ায় সন্তানহারা বাবার এই আকুতি। সাকিব হাসানের এই ব্যগ্রতা একদিন হয়তো শুনতে পাবে সমুদ্রও, ফিরিয়ে দেবে বড় আদরের পুত্রধনকে। সাকিব হাসান সেই ‘আলৌকিক উপহার’ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেই চলেছেন।