শেখ হাসিনার শেষ এক বছরে দেশে বেকারত্বের হারের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির পরিভাষায় বেকারত্বের হার ৩ শতাংশ হলেই কর্মসংস্থানের জন্য শোভনীয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন বেড়ে যাওয়াকে আশঙ্কাজনক বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএস প্রথমবারের মতো শ্রমশক্তি জরিপে ১৯তম আইসিএলস অনুযায়ী বেকারত্বের হার প্রকাশ করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন এ পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকে। সে অনুযায়ী বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে। আগের বছরের একই সময়ে দেশে বেকার জনগোষ্ঠী ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার।
এ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যে দেখা যায়, দেশে সেপ্টেম্বর শেষে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজারে। এ হিসাব এক বছরের তুলনায় ৩৫ লাখ কম। অবশ্য এ হিসাবটি দিয়েছে ১৩তম আইসিএলএস অনুযায়ী।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত এক বছরে দেশে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। সরকারি বেসরকারি সব বিনিয়োগই কমেছে। তাছাড়া গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবও পড়েছে বিনিয়োগে। যার ফলে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে, বেকারত্বের হারও বেড়েছে।
বিবিএসের নতুন পদ্ধতির হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, সম্প্রতি যে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহার করে হিসাবটি করা হয়েছে। যদিও এ পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক আছে। এটার মধ্যেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন আছে। আমাদের দেশে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব এসব পদ্ধতির মাধ্যমে উঠে আসে না।
বেকারত্বের হার কত হলে সেটি শোভনীয় এমন প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বেকারত্ব ৩ শতাংশ হলেই বলা হয়, এটি ফুল এমপ্লয়মেন্ট। অনেক সময় মানুষ একটি কাজ করা অবস্থায় অন্য কাজ খুঁজতেছে। একটু সময় লাগে। অর্থনীতিতে বলা হয়ে থাকে ৩ শতাংশ বেকারত্ব কাঠামোগতভাবে ঠিক আছে, কিন্ত আমাদের সেখানে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এটি তো পূর্ণ কর্মসংস্থানের কাছাকাছি। আসলে তো পরিস্থিতি তা না।
ড. মোস্তাফজুর রহমান বলেন, দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো যে কাজটি তারা করছে, সেটি শোভন কর্মসংস্থান কিনা। আমাদের দেশে বেশিরভাগই কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে কাজের স্থায়িত্ব নেই, মজুরি কম। সামাজিক নিরাপত্তা থাকে না, বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর কোনো তাদের কোনো সুবিধা নেই।
শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তানে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটের ধারাবাহিকতার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিনিয়োগের বাধার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকের উচ্চ সুদহার। এমন পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। এটি নেই নানা কারণে, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকের সুদের হার বেশি, নানা রকমের সমস্যা, ব্যাংকগুলোর চরম অসহযোগিতাসহ নানা কারণে একেবারেই বিনিয়োগ নেই।
সেপ্টেম্বর শেষে বেকার জনগোষ্ঠী এসে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৫০ হাজারে। এক বছর আগেও এ বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৩০ হাজার।
বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তারাই যারা গত ৭ দিনে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি কিন্তু কাজের জন্য গত সাতদিন ও আগামী দুই সপ্তাহের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এছাড়া গত ৩০ দিনে বেতন বা মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজেছেন তারাও বেকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবেন।
শ্রমশক্তি জরিপের ১৩তম আইসিএলএস অনুযায়ী তৃতীয় প্রান্তিকের তথ্য বলছে, দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।
দেশে বেকারত্বের হার বাড়ায় গত এক বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ না থাকা আর গত জুলাই থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী । তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন, ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, দেশে যত বেশি উৎপাদন বাড়বে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে। গত বছর কিংবা গত জুলাই কিংবা আগস্টের শেষেও নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বিনিয়োগ বাড়লেই দেশে উৎপাদন বাড়বে, ক্যাপাসিটি বাড়বে। তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হেবে, বেকারত্বের হারও কমবে।
বর্তমান সময়ে দেশে প্রবৃদ্ধির হার কম উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে দেশের প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম, ৪ শতাংশেরও নিচে। কারণ সরকারের বিনিয়োগও হচ্ছে না, বরং কমেছে। আবার বেসরকারি বিনিয়োগও হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কৃষি খাতের উৎপাদন কমে যেতে পারে। এখাতে আগেও তেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়নি।
