কাউকে রামদা দিয়ে কোপানো হয়, কাউকে আবার মারধরের পর ফেলে দেওয়া হয় ছাদ থেকে। গত রবিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর এভাবেই হামলা চালিয়েছে স্থানীয় গ্রামবাসী নামধারী দুর্বৃত্তরা। হামলার সময় তাদের অনেকের হাতে ছিল রামদা, লোহার রড কিংবা পাথর। সেই হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন। এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন তিনজন। হামলার ভিডিও-ছবি ছড়িয়ে পড়লে ঘটনার দিন বিকেলে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা স্থানীয় ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেন।
ঘটনার পরদিন ভাঙচুর হওয়া ঘরবাড়ির চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওঠে আসে। সেখানে অনেক গ্রামবাসী লাখ-লাখ টাকা লুটের অভিযোগও তোলেন। তবে তাদের সেই দাবি নিয়ে ভিন্ন কথা ওঠে এসেছে ঘটনাস্থলে কয়েকদফা পরিদর্শনে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বক্তব্যে। ছাত্রদের ফাঁসাতে গ্রামবাসী ‘নাটকের স্ক্রিপ্ট’ বানিয়েছেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
সংঘর্ষের পর বিকেল তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। এরপর হামলাকারীদের ধরতে জোবরা গ্রামে প্রবেশ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই দলে থাকা র্যাব-৭ এর উপ-সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ফেসবুকে দুই সময়ের চিত্র তুলে ধরেন। তার সেই স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ফেসবুক পেজ ও গ্রæপগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি।
ওই স্ট্যাটাসে র্যাব কর্মকর্তা লেখেন, ‘১৪৪ ধারা ঘোষণার পর যখন জোবরা গ্রামে ঢুকি, তখন রাস্তার পাশের বিভিন্ন বাড়ির টিনের বেড়াগুলো কিছুটা ভাঙা, থেতলানো ছিল। কিন্তু রাতে যখন আবার ঢুকি তখন দেখি সেগুলোতে দায়ের কোপ, দেখি আরও অনেক বিধ্বস্ত।’
ওই কর্মকর্তা তার নিজের এলাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লেখেন, ‘নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলা টেঁটাযুদ্ধ খ্যাত এলাকার মানুষ হিসেবে বুঝতে বাকি রইলো না, প্রতিপক্ষ মানে ছাত্রদের ফাঁসাতে আরও কিছু নাটকের স্ক্রিপ্ট বাড়ানো হয়েছে। কারণ, ছোটবেলা থেকে এসব ঝগড়া ফ্যাসাদ দেখে অভ্যস্তÑকীভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। অতঃপর, শুরু হলো ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র হনন!’
গতকাল সন্ধ্যায় স্ট্যাটাসের লেখা নিয়ে জানতে চাইলে ওই র্যাব কর্মকর্তা দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে যা দেখেছেন তাই ফেসবুকে তুলে ধরেছেন।
একইভাবে পরিদর্শনে যাওয়া আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা যখন বিকেলে গ্রামে ঢুকি তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিসোঁটা দিয়ে ঘরবাড়িতে আঘাত করার চিত্র দেখতে পাই। কিন্তু পরে যখন রাতে ঢুকি তখন দেখি সড়কে সড়কে গাছ-বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলা হয়েছে। বুঝতে পারি, যাতে বাইরে থেকে কেউ সহজে প্রবেশ করতে না পারেন সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সন্দেহ এই সময়ে ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলতে অনেকে নিজেরাই দা দিয়ে নিজেদের টিনের ঘরবাড়িতে কুপিয়েছেন। যাতে শিক্ষার্থীদের ওপর দোষ চাপানো যায়। শিক্ষার্থীরা জোবরায় রবিবার বিকেলেই গিয়েছিলেন, কিছু বাড়িঘরে আঘাতের পর দ্রুতই ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর ছাত্রদের কেউ ওদিকে যাননি। কেননা নিরাপত্তাহীনতায় আগেই জোবরার বিভিন্ন বাসায় ভাড়া থাকা শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে চলে আসেন।’
শিক্ষার্থীরাও শুরু থেকেই এই দাবি করে আসছিলেন। এছাড়া অনেক গ্রামবাসী গণমাধ্যমে ৫-১০ লাখ টাকা লুটের অভিযোগও তুলেছেন। এই দাবি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেছেন, ‘ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে-এমন কথা ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে লোভে পড়ে নিজেরাই নিজেদের কম ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি বড় আঘাত করে ভেঙেছেন। আবার টাকা লুটের গল্পও ফাঁদছেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন এই সাধারণ গ্রামবাসীর ঘরে ঘরে ৫-১০ লাখ নগদ টাকা এলো কোথা থেকে?
তবে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি স্থানীয় ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জোবরার বাসিন্দা আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘দিনদুপুরেই তো ঘরবাড়ি ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি এটি নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। আমরা চাই দ্রুত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। ছাত্র-স্থানীয় মানুষের সহাবস্থান আগের জায়গায় চলে আসুক। কেউ ইন্ধন দিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা চাই তাদের শাস্তি হোক।’