‘রক্ত ভয় পেতো যে ছেলে, সে-ই রক্তে লিখে গেল ইতিহাস’

লালখানবাজার থেকে হাই লেভেল রোড ধরে এগিয়ে পথের শেষে পৌঁছালেই পশ্চিমে মুখ করে থাকা একটি সুউচ্চ দালান। সেই ভবনের নিচতলার বাসাটিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো করুণ আবহ; যেন কিছু একটা হারিয়ে গেছে, চিরতরে। নিস্তরঙ্গ ড্রয়িংরুম। এক কোণে টেবিলে সাজানো নানা পুরনো বই। তারই ফাঁকে একটা এলবামে এক তরুণের নানা বয়সের ছবি। একদম উপরে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটি ক্যালিগ্রাফি। যেখানে বড় হরফে লেখা আছে সেই অমর বাণী, ‘যে হৃদয় শাহাদাতের উচ্চাকাক্সক্ষা লালন করে, সে হৃদয় কখনও হতাশ হয় না।’

 

এই বইগুলো যার, এসব ছবিতে যিনি, আর ওই লেখাটা যার- সেই ছেলেটা আর কোথাও নেই। আসবে না কোনদিন। নাম তার ফয়সাল আহমেদ শান্ত। ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবের শুরুতে আরও অনেক তরুণের সঙ্গে তিনিও বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছিলেন রাজপথে।

 

বই-ছবি দেখাতে দেখাতে ‘একটু আসি’ বলেই ভেতরে ঢুকলেন মোছাম্মৎ কহিনুর আক্তার। কিছুক্ষণ পর বাইরে ভেসে এলো রুদ্ধকণ্ঠের ফোঁপানি। হাতে কিছু কাপড় নিয়ে কহিনুর আবারও এলেন ড্রয়িংরুমে। বললেন, ‘এসব আমার ছেলের কাপড়। এগুলো আগলেই বেঁচে আছি।’ বলতে বলতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শান্তর রেখে যাওয়া সেসব জামার ওপর। ছেলের চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার। তার আগেরদিনের সন্ধ্যায় এই বেদনাহত মাকে পাওয়া গেলো ঠিক এভাবেই!

 

ছেলের চলে যাওয়ার সেদিনের প্রতিটি মুহূর্ত আজও জীবন্ত কহিনুর আক্তারের মনে। সেই স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দিয়ে এই মা বললেন, ‘ওর টিউশনি ছিল বিকেল ৩টা থেকে। তবে আন্দোলনে যোগ দিতে এক ঘণ্টা আগেই সেই টিউশনি শেষ করে ছেলে। তারপর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় মুরাদপুরে। বিদায়ের সময় বলে যায়- মা আমি চলে আসবো সন্ধ্যায়। চা আর পরোটা বানিয়ে রেখো।’

 

সন্ধ্যার দিকে ছেলের বড় পছন্দের চা-পরোটা বানাচ্ছিলেন মা কহিনুর। এমন সময়ে আসে ফোনটা। পরিচিত একজন ফোন করে দ্রুত তৈরি হতে বলেন। জানান, শান্তর গায়ে গুলি লেগেছে; যেতে হবে হাসপাতালে। তখনও কহিনুর জানেন না ছেলের অন্তিম পরিণতির কথা। ভেবেছেন পুলিশ হয়তো রাবার গুলি ছুড়েছে, সেটি শান্তর পায়ে লেগেছে। দ্রুতই চলে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু এসে কোনমতেই ছেলের কাছে যেতে পারেন না কহিনুর।

 

সেই অস্থির সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কহিনুর বলেন, ‘এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে বারবার আমাকে জেরা করে নানা কিছু জেনে নেন, কিন্তু কোনভাবেই আমার ছেলের হদিস দেন না। একপর্যায়ে পুলিশ আমাকে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে বিভিন্ন কাগজে সই করতে বলে। তখনই বুঝতে পারি ময়নাতদন্তের জন্য অনুমতিপত্রে আমার সই নেওয়া হচ্ছে। বুকটা ভেঙে যায় আমার। জানতে পারি, আমার ছেলের পায়ে নয়, গুলি করা হয়েছে বুকে। এরপর আমি জ্ঞান হারাই।’

 

চোখে জল, মনে দুঃখ নিয়ে কহিনুর বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলে রক্তকে খুব ভয় পেতো। সেজন্য কোরবানে গরু জবাই করার সময় আমরা তাকে লুকিয়ে রাখতাম। বাসায় কখনও ওর ভয়ে মুরগি জবাই করতাম না। আমার সেই নিরীহ ছেলেটাকে গুলি করে রক্তাক্ত করা হলো। আবার সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন গায়ে ময়নাতদন্তের নামে কাটাকুটো করা হলো। কত অনুরোধ করলাম, শুনেনি। তবে আমার এটাই সান্ত্বনা- যে ছেলেটা রক্ত ভয় পেতো, সেই রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখে গেলো।’

 

মায়ের আরও একটি আফসোস ফুরায় না। সেটি হলো- খুব ইচ্ছে ছিল শান্তর কবর হবে তারই প্রিয় চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু তখনকার প্রশাসন সেই অনুরোধ রাখেনি। এমনকি যে শহরের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে শান্ত, সেই শহরে তার নামাজে জানাজাও পড়তে দেওয়া হয়নি। মা সেসব মন খারাপের কথা আরেকবার শুনিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলের মরদেহ পুলিশ প্রটোকল দিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেছে। আহ! এভাবে যদি বেঁচে থাকতে নিরাপত্তা দিতো, হাজারো মায়ের বুক খালি হতো না! এখন তো আর ছেলেকে পাবো না। শুধু একটাই চাওয়া- যে হাজারো ছাত্রজনতা প্রাণ দিলো, তাদের রক্তের বিনিময়ে যেন বাংলাদেশটা সুন্দরভাবে চলে।’

 

এমইএস কলেজের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন শান্ত। প্রায় প্রতিদিনই ছেলের বন্ধুরা আসেন কহিনুর আক্তারকে দেখতে। তাদের মাঝেই যেন হারানো ছেলেকে খুঁজে পান সন্তানহারা মা। গতকাল বিকেলে ছেলের বন্ধুদের নাশতা দেওয়ার সময় চা বানাতে গিয়ে যেন আরও একবার শোকস্তব্ধ হলেন কহিনুর। বলেন, ‘দুধ চা আর পরোটা এখন কোনভাবেই বানাতে পারি না। সেসব খেতে গেলেই যে ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। কারণ বাইরে থেকে আসলে অন্য কিছু নয়, আমার শান্ত মণি যে শুধু আবদার করতো- মা একটা দুধ চা দিন, পরোটা দিয়ে।’

 

শুধু কি চা-পরোটা! মায়ের মনজুড়ে শুধুই যেন ছেলের বাস। তাই তো মুঠোফোনে ধরে রাখা ছেলের গলার আওয়াজ, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ধারণ করা ভিডিওতে ছেলের হাস্যোজ্জ্বল ঘোরাফেরা, নানা বয়সে তোলা ঝাপসা হয়ে যাওয়া কিছু স্থিরচিত্র আর রেখে যাওয়া পাঞ্জাবি, শার্ট, মোজা- এসবকেই আজ নিজের বেঁচে থাকার বড় সম্বল মানেন চল্লিশোর্ধ্ব এ নারী।

 

অন্য আট-দশটা নিম্নবিত্ত পরিবারের মায়ের মতো কহিনুর আক্তারও স্বপ্ন দেখতেন একমাত্র ছেলে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। সেখান থেকে এমন সাফল্য বয়ে আনবেন, একদিন ছেলের কল্যাণে সেরা মায়ের সম্মান পাবেন তিনিও। এখন ‘শহীদ’ ছেলের কল্যাণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি করে নিয়ে যাওয়া হয় কহিনুর আক্তারকে। মায়ের সম্মান পাওয়ার সেই স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে গেলো। বড় নির্মমভাবে সত্যি হয়ে গেলো!