শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগীর ঠাঁই নেই

 

শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগীর ঠাঁই নেই

রোগী বেড়েছে মা ও শিশু হাসপাতালেও । ঘন ঘন শ্বাস নিলে শিশুকে হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ । শিশুকে টিকাদানের ওপর জোর চিকিৎসকদের

 

জাহেদুল কবির | শনিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

 

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে বেড়েছে নিউমোনিয়া রোগীর চাপ। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে নিউমোনিয়ায় ভর্তি রোগী বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে শিশু রোগ বিভাগের দুটি ওয়ার্ডে সরকার অনুমোদিত বেডের তুলনায় রোগী ভর্তি থাকছে প্রায় তিনগুণ। চিকিৎসকরা বলছেন, এখন মৌসুম পরিবর্তনের কারণে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দিনের ভ্যাপসা গরম ও রাতে তাপমাত্রা উঠা–নামার কারণে কম বয়সী শিশুরা নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ভুগছে। বর্তমানে সরকারি–বেসরকারি সব হাসপাতালে নিউমোনিয়ার রোগী ঠাঁই নাই অবস্থা। অপরদিকে চট্টগ্রাম মা–শিশু ও জেনারেল হাসপাতালেও বেড়েছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গতকাল শুক্রবার বিকেলে চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, শিশুদের মায়েরা কোলে নিয়ে বসে আছেন। আবার কেউ শিশুকে নেবুলাইজ (শ্বাসযন্ত্রের ওষুধ প্রয়োগ) করছেন। এদের একজন ফটিকছড়ির সমিতির হাটের বাসিন্দা রাবেয়া আকতার। চোখে–মুখে ক্লান্তির চাপ স্পষ্ট। জানতে চাইলে তিনি বলেন, চারদিন আগে দেড় বছর মেয়ের ঠান্ডাজনিত সর্দি–কাশি হয়। স্থানীয় ডাক্তারকে দেখানোর পরে তিনি নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চমেক হাসপতালে পাঠিয়ে দেন। রাবেয়া আকতার বলেন, মেয়ে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে। বুকের দুধ খেতে পারছে না। পটিয়ার বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, আমার ছেলের বুকে কফ হয়েছে জানান ডাক্তাররা। পরে এখানে ভর্তি করে দেয়। দুইদিন ধরে এখানে আছি। এখনো ছেলের জ্বর কমছে না। এছাড়া শ্বাসকষ্টও আছে।

 

এদিকে চমেক হাসপাতালে বেড সংকটের কারণে একটি বেডে একসাথে তিন থেকে চারজন শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি অক্সিজেনের সঞ্চালন লাইন থেকে একাধিক শিশুকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়ম মতে–একজন শিশুকে একটি অক্সিজেন সঞ্চালন লাইন থেকে অক্সিজেন দেয়ার কথা। কিন্তু এখন নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেশি হওয়ার কারণে একটি সঞ্চালন থেকে একাধিক রোগীকে দিতে হচ্ছে। এতে আমরা প্রয়োজন মতো রোগীকে মনিটরিং করে অক্সিজেন দিতে পারছি না। আনুপাতিক হারে অক্সিজেনের পরিমাণ কম–বেশি হতে পারে।

 

চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওয়ার্ডে সরকার অনুমোদিত বেড আছে ১৩০টি। বর্তমানে গড়ে রোগী ভর্তি থাকছে ৪০০ এর কাছাকাছি। এছাড়া প্রতিদিন ১০০ জন নতুন রোগী আসছে, এরমধ্যে ৬০ জনই হচ্ছে নিউমোনিয়ার রোগী।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। সাধারণত যেসব শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের নিউমোনিয়া বেশি হয়। এছাড়া প্রি–ম্যাচিউরড (সময়ের আগে জন্ম নেয়া) শিশুদেরও নিউমোনিয়া বেশি হয়। ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিজনিত কারণেও নিউমোনিয়া হয়। এখন নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে গর্ভকালীর মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া স্বল্প বিরতিতে সন্তান জন্ম দিলেও সেই সন্তানের ওজন কম হতে পারে। মা–বাবা কেউ ধুমপায়ী হলে সন্তানের নিউমোনিয়া হতে পারে। পর্যাপ্ত আলো বাতাস ছাড়া স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশু নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে। শিশু জন্মের পর থেকে ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বুকের দুধে নিউমোনিয়া প্রতিরোধক ভিটামিন–এ থাকে। ফিডারে কোনো কিছু খাওয়ানো যাবে না। নিয়মিত হাত ধোঁয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ঘরে বড় কারো সর্দি–কাশি হলে শিশুদের তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া শিশুকে সরকার নির্ধারিত সব টিকা দিতে হবে। যেসব শিশুর ঘন ঘন সর্দি–কাশি হয় তাদের বেসরকারি ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা দিতে হবে। এসব নিয়ম মেনে চললে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের শিশু রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সেঁজুতি সরকার বলেন, আমাদের ওয়ার্ডে দুই তৃতীয়াংশই এখন নিউমোনিয়ার রোগী। বছরের এই সময়টাতে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ে, এটি একদম স্বাভাবিক। নিউমোনিয়া মূলত ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। রোগের শুরুতে কাশি হয়, যা সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে শিশুর বুক বেশি দেবে গেলে, ঘন ঘন শ্বাস নিলে, মায়ের দুধ পানে সমস্যা ও খিঁচুনি হলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

 

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের শিশু রোগ বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মুসা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। আমাদের আগে থেকেই সরকার অনুমোদিত বেডের তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকে। এখন আমরা তো কোনো রোগীকে ফেরত দিতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে এক বেডে একাধিক রোগীকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যেও আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাটুকু দিয়ে যাচ্ছি