প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর করার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিপক্ষে বিএনপিসহ তিনটি দল মত দিয়েছে। আর এর প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপিসহ বাকি ২৭ দল। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে। দ্বিতীয় পর্যায়ের পঞ্চম দিনের সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা সুস্পষ্ট এক জায়গায় এসেছি। একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এ রকম একটি জায়গায় আসার পরে আমরা এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। আলোচনার পরে তিনটি দল ভিন্নমত পোষণ করে, তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে। তারা তাদের দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে আবার আলোচনা করবেন বলেছেন। তারা মনে করেন, এই বিষয়ের সাথে অন্যান্য বিষয় যুক্ত, বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল–এনসিসি গঠন ও সংসদের উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠন হবে। ওইসব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার সময় তারা বিষয়টি উপস্থাপন করবেন।
বিপক্ষে মত দেওয়া তিনটি দল হলো বিএনপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি)। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ১০ বছরের বিষয়ে জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপিসহ তিনটি দল দ্বিমত পোষণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা লিখিত প্রস্তাবে এবং আমাদের ৩১ দফার লিখিত প্রস্তাবের মধ্যে যা ছিল সেটা আমরা পুনরায় উল্লেখ করেছি। কোনো ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবে না। এখানে মেয়াদটা নিয়ে সবসময় বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা এসেছে। কারো কারো প্রস্তাবে দুইবার এসেছে। বারের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে একবারের জন্য, সাপোস তিন মাসের জন্য অন্য কেউ হলেন। সংখ্যা গরিষ্ঠ দল আরেকজনকে প্রধানমন্ত্রী করলেন। তারপর হয়তো আগেরজন প্রধানমন্ত্রী হলেন। তাহলে তো তার আর দুইবার পূরণ হয়ে যায়নি। এই দুইবার, তিনবার বা পাঁচবারও এক বছরের ভিতরে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বার নিয়ে ব্যাখ্যাটা সম্মত কারণে যথেষ্ট নয়।
বিএনপির এই নেতা বলেন, মেয়াদের ক্ষেত্রে আমরা যে বিষয়টি মাথায় রেখে কথা বলেছিলাম সেটা হচ্ছে, সাধারণত সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। পাঁচ বছর সংসদ বহাল থাকবে কিনা সেটা সংসদের উপর নির্ভর করে। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে যে সংসদ পাঁচ বছরে হবে। তিনবারে হোক, চার মেয়াদে হোক, সর্বোচ্চ বছরটা যদি আমার উল্লেখ করতে পারি, একজন লোক জীবদ্দশায় এত বছরে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, আমি নির্দিষ্ট করে কোনো বছর উল্লেখ করিনি। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে আমার দলের পক্ষ থেকে আমার নেই। যদি মেয়াদের বিষয়ে বৈঠকে একটা সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে আমাকে আমার দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দুই মেয়াদের সরকার বলতে আমরা পূর্ণ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীত্বকেই বলেছি। সে অনুযায়ী ১০ বছর দুই পূর্ণ মেয়াদই হয়। একই সংসদীয় মেয়াদে একাধিকজন প্রধানমন্ত্রী হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যর ক্ষেত্রে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ও দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে একটা ঐকমত্য ছিল যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদটা সীমিত করা প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান যে ব্যবস্থাটা আছে সেটা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। দুইবার বা দুই মেয়াদ নিয়ে আলোচনা চলছিল, আরেকটি প্রস্তাব আসল সর্বোচ্চ একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় কত বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সেটা নির্ধারণ করলে হয়তো ভালো হবে। আলোচনার পর অনেকেই একটা জায়গায় চলে আসে যে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। এনসিপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল, এক ব্যক্তি দুইবার প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ নিতে পারবেন। যদি ঐকমত্যের স্বার্থে সকলেই ১০ বছরের কথা বলে সেক্ষেত্রে সময় নির্ধারণের জন্য এনসিপি নমনীয় থাকবে। তিনি বলেন, পরে আলোচনা আসল যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ যদি সীমিত করতে হয় এর পাশাপাশি উচ্চ কক্ষ সমানুপাতিক পদ্ধতিতে গঠন, এনসিসি এসব নিয়েও আলোচনা করতে হবে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেকটাই কমে যাবে। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান হচ্ছে এনসিসি বা সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা চাইব নির্বাচন কমিশনের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে না।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে দুদিন বৈঠক মুলতবি করা হয়েছে বলে জানান ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেন ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। এদিন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসে কমিশন। বৈঠকের শুরুতে আলোচিত উচ্চকক্ষ গঠন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি। জুলাই সনদ তৈরির লক্ষ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছুতে ছাড় দিতে রাজনীতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।