
‘ক্যান গরি গইরগুম বিয়া, স্বর্ণের দাম দুই লাখ ট্যাঁয়া’- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এই গানটি এখন বেশ ভাইরাল। ফেসবুক-টিকটকে ঢুকলে গানটি কানে বাজবেই। অনেকে রসিকতা করে গানটি গাইলেও সোনার দাম যেভাবে আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে কথাগুলো এখন অনেকটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে অনেকের জীবনে! সোনার গহনার এমন উচ্চমূল্য তরুণদের মনে তৈরি করেছে এক ভয়-‘বিয়েভীতি’।
সোনা দামি থেকে অতি দামি হয়ে কয়েক সপ্তাহ আগেই দুই লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি ভরি প্রতি কিছুটা কমলেও সেই স্বস্তির ঢেউ তেমনভাবে পৌঁছায়নি বিয়ের বাজারে। চট্টগ্রামে বিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা-‘অলংকার-আড়ম্বর-আহ্লাদ’-এর সংস্কৃতি এই দাম কমাকে তুচ্ছ করে দিয়েছে। কারণ এখানে বিয়ে মানেই শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়-এটি বর-কনের পরিবারের ‘সম্মান রক্ষার প্রকল্প’।
চট্টগ্রামে বিয়ে মানেই সোনাররীতি: চট্টগ্রামের বিয়েতে, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে বর-কনে দুই পক্ষেরই সোনার গহনা দেওয়ার চল থাকলেও বোঝার বড় অংশটি পড়ে বরপক্ষের ওপর। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় কনে চ‚ড়ান্ত করার আনুষ্ঠানিক দিন ‘ফুলনিশান’ থেকে। ওইদিন ছেলের পরিবার মেয়েকে সোনার অলংকার দিয়ে ‘নিশান’ রেখে যান, যেন আর কোনো পাত্রের কাছে তাদের হবু বউকে দেখানো না হয়। এরপর তৈরি হয় দীর্ঘ ফর্দ-কাবিন, সোনা, সাজসজ্জা, খাওয়া-দাওয়ার খরচ, উপহারÑপ্রতিটি বিষয় হিসেবের খাতায় ঢোকে। বিয়ের আগেই ফর্দে উল্লেখিত গহনা কনের পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ে পক্ষকেও বর ও তার পরিবারকে উপহার হিসেবে সোনা দিতে হয়।
অতীতে সোনার দাম কম থাকায় বরপক্ষের ওপর বোঝাটা কম ছিল, বেশিরভাগ চাপই যেত কনের পরিবারের ওপর দিয়ে। এখন সোনার দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় বরপক্ষের মাথাব্যথাও বেড়েছে। অন্যদিকে হিন্দু বিবাহেও সোনাকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে ধরা হলেও গহনার পরিমাণ নির্ধারিত হয় বর-কনের সামর্থ্যরে ওপর।
বাড়ছে বিয়েভীতি: এক গবেষণায় উঠে এসেছে, আগে বর-কনের সামর্থ্যের ওপরেই চট্টগ্রামের সব আয়োজন নির্ধারণ হতো। এখন জাহির করার প্রতিযোগিতা সেই রীতিকে ম্নান করেছে। কেবল সোনা নয়, মোহরের পরিমাণ নিয়েও এখানে দরকষাকষি হয়। অনেক সময় তো ফর্দের পরও বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অবশ্য এত খরচ করে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের পরিবার নিশ্চয়তা চান, যাতে বিবাহবিচ্ছেদ না ঘটে। অনেক সময় তালাক রুখতেই বড় অঙ্কের মোহরানা-সোনার গহনা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু লোকদেখানোর রীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে চট্টগ্রামের তরুণদের মধ্যে গড়ে উঠছে বিয়েভীতি। এ কারণে দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতাও বাড়ছে।
সম্প্রতি বিয়ে করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘বয়স বাড়ছিল, বিয়ের চাপও তাই বাড়ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই সাহস করতে পারছিলাম না। কারণ জমানো টাকা ছিল না। কিন্তু বিয়ে মানেই তো লাখ লাখ টাকা খরচ। মোহরানার চাপ তো আছেই। এর মধ্যে সোনার দাম আকাশচুম্বী। শেষ পর্যন্ত চার লাখ টাকা ঋণ করে দুই ভরির একটু বেশি সোনা স্ত্রীকে দিয়েছি। এখন মাসে মাসে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে, বড় কষ্টে দিন কাটছে।’
আরেক তরুণ নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমি নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বয়স ৩০ পার হয়েছে। কিন্তু সোনা-মোহরানার কথা ভেবে বিয়ের সাহসই পাচ্ছি না।’
তবে ইসলামে বিয়েতে সোনা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের নতুন সভাপতি ও মেহেদীবাগ সিডিএ জামে মসজিদের খতিব অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার। তিনি বলেন, ‘ইসলামে বিয়ের শর্তের মধ্যে অন্যতম ফরজ হলো মোহর। সেই মোহর নগদ টাকা, সোনা, রূপা বা অন্য কোনো সম্পদ হিসেবে হতে পারে।’ অর্থাৎ সোনা ছাড়া বিয়ে হয় না-এই ধারণা ধর্মীয় নয়, সমাজের শর্ত।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রণব সাহা দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘বৈশ্বিক নানা কারণে সোনার দাম বেড়েই চলেছে। আর সেটির প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপর। এখন আমাদের ব্যবসা একেবারেই খারাপ। কেননা, দাম বাড়ায় মানুষ কিনতে পারছে না। আবার অতি দামের কারণে তরুণদের মধ্যে বিয়েভীতিও বাড়ছে। ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে উদ্বেগ আছে।’
ছোট পরিসরে বিয়েই সমাধান!: স্বর্ণের দাম বেড়ে চলায়, ইসলাম ধর্মের অনুসারী তরুণদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিন্নরকম প্রচারণা শুরু করেছেন। এই ক্যাম্পেইনের নাম ‘এক ভরি সোনার দাম দুই লাখ টাকা। আর ওমরা করতে লাগে দেড় লাখ টাকা। অতএব বউকে সোনা নয়, ওমরা উপহার দিন।’ তবে এটিকে চূড়ান্ত সমাধান বলে মনে করেন না অনেকে। ছোট পরিসরে বিয়েই কার্যকর সমাধান বলা হচ্ছে। সেটি বাস্তবায়ন করা গেলেই বর-কনে উভয়পক্ষই লাভবান হবে, সেই বিশ্বাস সবার।