আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের তাৎপর্য

তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছায়। এতে বান্দা তাঁর স্মরণে আনন্দ, ইবাদত, আনুগত্যে পরিতৃপ্তি ও উত্সাহ পায়। মহান আল্লাহর ঘোষণা—‘তার চেয়ে ধর্মে উত্তম কে, যে সত্কর্মপরায়ণ (তওহিদবাদী) হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১২৫)

পবিত্র কোরআনে আরো আছে —‘আর জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা জানেন। কাজেই তাঁকে ভয় করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৫)

তাওহিদ অর্থ একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্থির করা বা একত্ববাদ। পারিভাষিক অর্থে মহান আল্লাহকে তাঁর সুমহান জাত (সত্তা) সর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত নাম ও সিফাতে (গুণাবলী, বৈশিষ্ট্যে) এবং তাঁর অধিকার, কর্ম ও কর্তৃত্বে এক, অদ্বিতীয় ও একক ঘোষণা করা এবং এসব ক্ষেত্রে নিজের কথা, কাজ ও আন্তরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে মহান আল্লাহর একত্ব সমুন্নত রাখা।

তাওহিদ প্রধানত তিন প্রকার। যথা:
এক. রুবুবিয়্যাহ, অর্থাত্ কথা, কাজ ও বিশ্বাসের মাধমে মহান আল্লাহকে তাঁর সব কর্ম ও কর্তৃত্বে এক ও অদ্বিতীয় তথা লা-শারিক (অংশীদারহীন) স্বীকার করা।
দুই. উলূহিয়্যাহ, অর্থাত্ ইবাদতে মহান আল্লাহর একত্ব সমুন্নত রাখা। ইবাদত করতে হবে একমাত্র আল্লাহর, চাইতে হবে কেবল তাঁর কাছে, আনুগত্যও করতে হবে তাঁরই।
তিন. আসমা ওয়াসি্সফাত, অর্থাত্ মহান আল্লাহকে তাঁর নাম ও গুণাবলীতে এক ও অদ্বিতীয় স্থির করা, বিশ্বাস করা, তথা আল্লাহর সুমহান নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহর একত্ব সমুন্নত রাখা।

প্রভুত্ব, প্রতিপালন ও ইবাদতের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ অনন্য ও একচ্ছত্র। সুরা নাসে অত্যন্ত সুন্দর, সাবলীল ও সংক্ষিপ্তভাবে প্রসঙ্গটি ফুটে ওঠেছে ‘রাব্বিন নাস (মানুষের পালনকর্তা), মালিকিন নাস (মানুষের অধিপতি), ইলাহিন্ নাস (মানুষের মাবুদ)।’

মানবজীবনের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা হলো, সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি পূর্ণআস্থা ও বিশ্বাস। ‘ঈমান’ অর্থ নিছক বিশ্বাস নয় বরং এর প্রতি শব্দ ‘তাসদিক’ অর্থাত্ সত্য বলে স্বীকার করা। এরই অন্তর্নিহিত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে একজন মুসলমানের সব কথা, কাজ ও বিশ্বাসে। এ চেতনার বিকাশই ইসলামের লক্ষ এবং তা মহান আল্লাহ মনোনিত পরিপূর্ণ জীবনদর্শন। মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন—‘মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল থাকে এবং তা হতে বিচ্যুত্ হয় না….. আর এরাই তো প্রকৃত সত্য নিষ্ঠ।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১৫)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)

ঈমানি দুর্বলতা কুফরি, মুনাফিকি ও ফাসিকির পথে মানুষ ক্রমে ক্রমে আমলহীন, বেঈমান ও পাপীতে পরিণত হয়। আসল কথা হলো, ঈমান ও কুফরি একসঙ্গে থাকতে পারে না। কেননা :
(১) যে অন্তরে বিশ্বাস করেনি, মুখে তা ঘোষণা করেনি—সে প্রকাশ্য কাফির।
(২) যে অন্তরে বিশ্বাস করেনি, শুধু ইসলামী সমাজের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য মৌখিক স্বীকৃতি দেয় সে কপট বিশ্বাসী, গুপ্ত কাফির তথা ‘মুনাফিক’।
(৩) যার অন্তরের বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতি আছে অথচ আমলের ক্ষেত্রে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে, এরূপ দুরাচারীকে ‘ফাসিক’ বলা হয়।

প্রকাশ্য ঘোষণা, আন্তরিক বিশ্বাস, ত্রম্নটিহীন ও পরিপূর্ণ আমলদার ব্যক্তিই প্রকৃত বা ‘কামিল মু’মিন’। আমাদের কাজ হলো ঈমান-আমলের পথে শুধু এগিয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিচ্ছেন “তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণ ভাবে প্রবেশ কর” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০৮)।

বস্তুতঃ তাওহিদি আচ্ছাদনের বাইরে পালাবে কোথায় বান্দা? মহান আল্লাহ্র নজরদারির বাইরে যেতেও সে অক্ষম! বর্ণিত আছে, যুলায়খা যখন ইউসুফ (আ.)—কে নির্জনে পেলো, তখন দাঁড়িয়ে গেলো এবং ঘরে সংরক্ষিত মূর্তির চেহারা ঢেকে দিলো। ইউসুফ (আ.) বললেন ‘তুমি কি একটি নিষ্প্রাণ জড়পদার্থ দেখবে বলে লজ্জা পাচ্ছো? তবে আমি মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ্র নজরদারিতে লজ্জা পাবো না কি’?

তাই ‘ঈমান ও ইসলামে’র প্রকৃত স্বরূপ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবির নিবেদন—
“আল্লাহে্ত যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান…
যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া
জ্বীন পরী ইনসান…”।