হিজরতের পঞ্চম বছরে শাওয়াল মাসে মহানবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে পারলেন, মক্কার কোরাইশসহ আরবের অন্য কিছু মুশরিক গোত্রের ঐক্যবদ্ধ বিশাল সেনাবাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্য মুসলমানদের পুরোপুরি নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
নবিজি (সা.) সাহাবিদের সাথে পরামর্শের জন্য বসলেন যে, কী করা যায়? এই বিশাল সেনাবাহিনীর তুলনায় মদিনায় মুসলমান যোদ্ধাদের সংখ্যা খুবই কম। সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদেরকে পরাজিত করা তো কঠিন হবে! সাহাবিরা বিভিন্ন রকম পরিকল্পনা ও মতামত তুলে ধরলেন। অনেকে বদরের মতো সরাসরি লড়াই করার পক্ষে মত দিলেন। অনেকে মদিনার ভেতরে থেকে প্রতিরোধ লড়াই করার পক্ষে মত দিলেন।
তাদের মধ্যে ছিলেন ইরানি সাহাবি সালমান ফারসি (রা.)। তিনি ইরানের ইস্ফাহানে এক অগ্নিপূজক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি সত্য ধর্ম বা আল্লাহর দীনের অনুসন্ধান করা শুরু করেন। প্রথমে তিনি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর শেষ নবি মদিনায় আসবেন জানতে পেরে অনেক সংগ্রাম করে মদিনায় আসেন এবং নবিজির (সা.) হিজরতের পর ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, পারস্যে বা ইরানে আমরা যখন এ রকম সংকটে পড়তাম, তখন আমরা আমাদের চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করতাম। মদিনাকে রক্ষা করার জন্য আমরা কি পরিখা খনন করতে পারি?
আরবরা এই যুদ্ধকৌশলের সাথে পরিচিত ছিল না। সালমান ফারসির (রা.) কাছে বিস্তারিত শুনে নবিজি (সা.) তার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং পরিখা খনন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মদিনার উত্তর দিক ছিল উন্মুক্ত ও অরক্ষিত। অন্যান্য দিক পাহাড় ও বাড়িঘরের কারণে সুরক্ষিত ছিল। তাই নবিজি উত্তর দিকে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রতি দশজন সাহাবিকে ৪০ হাত পরিখা খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সকল সবল পুরুষ সাহাবিসহ নবিজি (সা.) নিজেও পরিখা খননে অংশগ্রহণ করেন।
ওই কঠিন ও সংকটপূর্ণ সময়ের কথা তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন তারা তোমাদের কাছে এসেছিল তোমাদের ওপরের দিক থেকে এবং তোমাদের নিচের দিক থেকে আর যখন চোখগুলো বাঁকা হয়ে পড়েছিল এবং প্রাণ কন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকম ধারণা পোষণ করছিলে। সেসময় ছিল মুমিনদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা, এবং তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। (সুরা আহযাব: ১০, ১১)
ঐতিহাসিক ও মুফাসসির ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এখানে তার অনুগ্রহ, করুণা এবং মুমিনদের প্রতি তাঁর সাহায্যের কথা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি কীভাবে শত্রুদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন এবং তাদের পরাজিত করেছিলেন। এটি ছিল খন্দকের যুদ্ধ যা সংঘটিত হয়েছিল হিজরতের পঞ্চম বছরের শাওয়াল মাসে। (তাফসিরে ইবনে কাসীর)
মুশরিকদের সেনাবাহিনী দ্রুত মদিনার দিকে এগিয়ে আসছিলো। প্রতিদিনই তাদের অগ্রযাত্রার খবর পাচ্ছিলেন নবিজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম। এর মধ্যে মাত্র ছয় দিনে তারা এক বিশাল পরিখা খনন করতে সক্ষম হন যেটির দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ হাজার হাত, প্রস্থ ছিল নয় হাত এবং গভীরতা ছিল অন্তত সাত হাত।
পরিখা দেখে মুশরিকদের বাহিনী প্রথমত অপ্রস্তুত ও হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তারা এ রকম কোনো কৌশলের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তারপর তারা পরিখার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দুর্বল কোনো জায়গা খুঁজতে থাকে, যেন সেদিক দিয়ে তারা প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু ঘোড়া দৌড়িয়ে অতিক্রম করতে পারে এ রকম কোনো দুর্বল জায়গাও তারা খুঁজে পায়নি।
তখন তারা দূর থেকে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করতে থাকে। আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবিরা পরিখার পাহারা দিতেন এবং মুশরিকদের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। মুসলমানরা দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করতেন, যাতে শত্রুরা সাহস করে পরিখার কাছাকাছি আসতে না পারে।
প্রায় এক মাস ধরে এমন অবস্থা চলতে থাকে—দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হয়ে শুধু তীর নিক্ষেপ ও অবরোধ চলতে থাকে। এরপর আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয় দান করেন, মুশরিকদের পরাজিত করেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এক প্রবল বাতাস যা মুশরিকদের তাঁবু উপড়ে ফেলে, তাদের আগুন নিভিয়ে দেয়, তাদের মনোবল ভেঙে দেয় এবং তাদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাদের সব শত্রুতা ও ক্রোধসহ পরাজিত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ কাফিরদেরকে তাদের আক্রোশসহ ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোন কল্যাণ লাভ করেনি। যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ প্রবল শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সুরা আহযাব: ২৫)
এরপর থেকে আরবের মুশরিকদের পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। খন্দকের যুদ্ধের পর আল্লাহর রাসুল (সা.) ঘোষণা দেন, এখন আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করব, তারা আর আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না; এখন আমরাই তাদের দিকে এগিয়ে যাব। (সহিহ বুখারি)